কলকাতা: সন ১৯৮০। তখন বাড়ির ছাদে অ্যান্টেনা ছিল। অ্যান্টেনায় কাক ছিল। লাল সাইকেলে চেপে ডাকহরকরার যাতায়াত ছিল। পাড়ার ডাক্তারের ভিজিট আড়াই টাকা ছিল। এক পয়সা, দু’পয়সা, তিন পয়সা, পাঁচ পয়সা ছিল। আর ছিল মস্কো অলিম্পিক। আর ছিল ম্যাসকট মিসা।
বাঙালির তখন মস্কো ছিল। বাঙালির লেনিন ছিল। আট আনার কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো ছিল, সোভিয়েত দেশ, সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে দুটি বই ছিল, যে বই কেউ পড়ত না । বইয়ের মলাট দিত। আর ছিল মস্কো অলিম্পিক। আর ছিল হকি। আর ছিলেন মহম্মদ শাহিদ, জাফর ইকবাল, ভাস্করন, বীরবাহাদুর ছেত্রীরা।
আরও পড়ুন- বাঘের হালুম ও খোদার খোদকারি
একশো বছর হয়ে গেল। কোনও বাঙালি আজ পর্যন্ত ব্যক্তিগত ইভেন্টে অলিম্পিকে পদক পায়নি। কিন্তু তাতে কী! যে-জিনিস আমরা পাইনি, বা কোনও দিন পাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, তার পিছনে আমাদের দৌড় দেখার মতো। আমরা বিপ্লবের পিছনে ছুটেছি, মস্কো থেকে লেনিনকে এনে বসিয়েছি ধর্মতলার ট্রাম গুমটির পাশে, তারপর কবিতা লিখেছি, ‘একটু পা চালিয়ে ভাই।’ বিপ্লব আসেনি। আসবেও না কোনও দিন। তবু আমরা বিপ্লবের নেশায় মশগুল, তবু আমরা পদকের নেশায় রাত জাগি। মস্কোতে হকিতে সোনা পেয়েছিল ভারত। টোকিওতে পেল ব্রোঞ্জ। এই ৪১ বছরে দুনিয়া যত তোলপাড় হয়েছে, সভ্যতার ইতিহাসে বোধহয় এত তোলপাড় হয়নি। না, এই সময়ে বিশ্বযুদ্ধ হয়নি। হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু।
মস্কোর পর টোকিওয় মেডেল জেতা মানে তাই আমাদের হাফ প্যান্ট আর টেপ জামার যুগে ফিরে যাওয়া। একটা ব্রোঞ্জ মেডেল মানে সুপুরির ডালে চেপে ফিরে যাওয়া সুদূর অতীতে, যে অতীত যেন গতজন্ম। আসলে ব্রোঞ্জ মেডেল নয়, আমরা যেন বাড়ি খুঁজে পেয়েছি, যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোনকে খুঁজে পেয়েছি, যেন বড়লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়া গামছা-পাড় শাড়ির প্রেমিকাকে খুঁজে পেয়েছি। সোনার কেল্লার মুকুলের মতো ঘোর লাগা চোখে বলছি, ‘এটা রতনের বাড়ি। এটা গিরিধারির। এখানে আমরা হোলি খেলতাম।’
আরও পড়ুন- কারগিলের লাইন অফ কন্ট্রোলে দাঁড়িয়ে
বাঙালি হকি স্টিক নিয়ে সিনেমায় মারপিট করেছে। কিন্তু হকি সেভাবে খেলেনি। ময়দানে কেউ হকি খেলা দেখতে যায় বলে শুনিনি। সারাক্ষণ ঝুঁকে দৌড়োনোর মতো কোমরের জোর বাঙালির নেই। কিন্তু তাতে কী। আমরা লেসলি ক্লডিয়াসের নামে রাস্তা বানিয়েছি, গুরুবক্স সিংকে তো আমরা প্রায় বাঙালিই বানিয়ে ফেলেছি। যেন তিনি গুরুবক্স চক্রবর্তী কিংবা গুরুবক্স তালুকদার। খেলি আর না-ই খেলি, সম্মান জানিয়েছি যথাযথ। মস্কোয় সোনাজয়ী দলের গোলরক্ষক বীরবাহাদুর ছেত্রী বাংলায় থাকতেন। তাঁকে নিয়ে আমাদের মাতামাতি ছিল দেখার মতো।
মস্কোয় বহু দেশ খেলেনি। আমেরিকা ও তার তাঁবেদার দেশগুলো মস্কো অলিম্পিক বয়কট করেছিল। তখন ঠান্ডা যুদ্ধের যুগ। আমেরিকার কালো হাত আলকাতরার কালিতে লেপে দেওয়ার যুগ, পাড়ার বড়লোকের বাড়িতে সন্ধে হলে টিভি দেখতে যাওয়ার যুগ। মহম্মদ শাহিদ ও জাফর ইকবাল নামে দুই হকি খেলোয়াড় তখন আমাদের নায়ক। তাঁরা যখন স্টিক হাতে ছুটছেন, তখন যেন সবুজ ঘাসে ফুটে উঠছে মল্লিকা অথবা চামেলি। হকি খেলা যে এত সুন্দর আগে বুঝিনি। স্পেনকে হারিয়ে সোনার মেডেল যেদিন এল, বাঙালি সেদিন আপনবেগে পাগলপারা।
আরও পড়ুন-কার্টুন তোমার দিন গিয়াছে
সেই পাগলপারা নদী যেন ৪১ বছর ধরে ছুটে চলে অবশেষে খুঁজে পেয়েছে বাঙালির উঠোন। এই নদীর জলে গুগল নেই, এই জলে সিম কার্ড নেই, এই জলে ডাউনলোড, আপলোড নেই, এই জলের অধিকারেই আমরা স্পর্শ করেছিলাম প্রেমিকার স্বপ্নে পাওয়া আঙুল।
টোকিওর ব্রোঞ্জ তাই শুধু একটি মেডেল নয়। দীর্ঘ সিঁধ কেটে একটি সোনার যুগের কাছে পৌঁছে যাওয়া, যা সোনার না-হলেও সোনার। যেখানে হোয়াটসআপ বা মেসেঞ্জার নেই, হলুদ পোস্টকার্ডে আবছা ভাসছে দু’একটা শব্দ—-শ্রীচরণেষু বাবা, আশা করি, কুশলেই আছ…।
কুশলে কি আছি কেউ? কে জানে!