ছাপ্পান্ন ইঞ্চির রাজাবাহাদুর শ্রীনরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি ঘোষণা করলেন, পৃথিবীর মোট সত্তর শতাংশ বাঘ ভারতবর্ষের বুকে নিশ্চিন্তে বেঁচে আছে, সংখ্যাটা ২৯৬৭। আর আমাদের রাজ্যের হিসেবটাও নেহাত ফেলনা নয়, ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ সালের বাঘসুমারি অনুযায়ী সুন্দরী গাছের আনাচকানাচে দক্ষিণরায়দের সংখ্যাটি প্রায় ১০০ ছুঁই ছুঁই- ৯৬!
দক্ষিণরায়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কিন্তু আজকের নয়। আজ এই বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবসে নোনাজলের ঝাপটায় অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে কয়েকলাইন কবিতা খুঁজে পেলাম, কবিতা না বলে স্বপ্নাদেশ বলা ভালো- পেলেন কে? নাহ, আমি নই- মক্কার অধিবাসী বেরাহিম / ইব্রাহিম, যার স্ত্রী ফুলবিবি সন্তানহীন ছিলেন।
” দোছরা করিলে সাদি জানিবেক খাটি
তাহার উদরে পয়দা হবে বেটা বেটি।।”
যেমন কথা তেমনি কাজ! সাদি তো হলো, কিন্তু ফুলবিবি মেনে নেবেন এত সহজে? তাঁর ষড়যন্ত্রে গভীর জঙ্গলে ইব্রাহিমের দ্বিতীয় স্ত্রী প্রসব করলেন যমজ কন্যা-পুত্র; বনবিবি ও শাহ জঙ্গালি। অতি দুঃখে দিন কাটে তাঁদের, কিন্তু সবসময় সহায় বনের প্রাণীরা।
” বনের হরিণ সব খোদার মেহের
হামেশা পালন করে বনবিবির তরে
বেহেশতের নুর এসে কোলে কাঁখে নিয়া
তুষিয়া মায়ের মত ফেরে বেড়াইয়া।।”
অতএব বোঝাই যাচ্ছে, “খোদার আরশ” অর্থাৎ আসনে অধিষ্ঠানের ক্ষমতা বনবিবি সঙ্গে নিয়েই জন্মান। সেই খোদার খোদকারিতেই বনবিবি ও শাহ জঙ্গালি এসে উপনীত হলেন সুদূর মক্কা থেকে এক অজানা অচেনা দেশে, যার নাম “আঠেরো ভাটির দেশ”- নিত্যদিন জোয়ার ভাটা খেলা করে যেখানে, আমাদের আজকের সুন্দরবন।
এ বার আমরা একটু “ক্রোনোলজি” বোঝার চেষ্টা করি। না না, গুজরাটি জানতে হবে না, বাংলা ভাষাতেই বুঝব। “বোনবিবির জহুরানামা” এবং বিভিন্ন উপকথা, প্রচলিত পালা গান এ আমরা পাই বনবিবির মক্কা হতে আগমনের বার্তা। অতএব, সুদূর মক্কা থেকে মানুষ “ভালো-বাসা” খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছল সুন্দরবনে, সেখানে তখন প্রবল পরাক্রমশালী এক শাসক, যার সঙ্গে মানুষের সংঘাত অবশ্যম্ভাবী, কেউ বলে বাঘ, কেউ বলে তাঁর নাম দক্ষিণরায়।
“নিন্দের খুমারো ধোনা হাতে কয়।
আপনি কে বটে মোরে দেহ পরিচয়।।
শুনিয়া দক্ষিণরায় কহে এ প্রকার।
মোম মধু বাদাবনে সৃজন আমার।।
দণ্ড বক্ষ মুনি ছিল ভাটির প্রধান।
দক্ষিণা রায় নাম আমি তাহার সন্তান।।”
কারও মতে সেই সময় হিন্দু রাজা মুকুট রায়ের আত্মীয় দক্ষিণরায় ছিলেন বাদাবনের হর্তাকর্তাবিধাতা। আবার কেউ বলেন দক্ষিণরায় স্বয়ং মার্জারকূলশিরোমণি শার্দূলঠাকুর স্বয়ং। কবে প্রবল পরাক্রমশালী রাজা এবং বাঘবাবাজি একাকার হয়ে গেলেন সে তর্ক গবেষকরা করবেন না হয়, “ক্রনোলজি” অনুযায়ী মোদ্দা কথা হলো প্রবল পরাক্রমশালী শত্রুকে ঠেকানোর জন্য “ছাপোষা বাঙালির” পূর্বপুরুষদের তখন একটি শক্তির প্রয়োজন ছিল, যার ফলে বনবিবির আসরে আগমন।
ফলে, আজও সুন্দরবন বোধকরি পৃথিবীর একমাত্র স্থান, যেখানে মুসলমান ধর্মাবলম্বী লোকজন মূর্তিপূজা করেন, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানুষ গড় হয়ে বনবিবির পূজা করেন বাঘ-বাহাদুরের বাহাদুরির হাত থেকে রক্ষা পেতে। অথচ, দক্ষিণরায়ও তাঁদের কাছে সমানভাবে পূজ্য, তাঁর শৌর্য বীর্য বীরত্বের গাঁথা অমর হয়ে আছে অজস্র পালাগানে, লোকগাঁথায়। রোজই কারোর বাড়ির ছেলেটা, কারোর বাড়ির মানুষটা বড়ঠাকুরের কাছে চলে যায়-তবু আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে লালগড়ের সেই অশিক্ষিত গাঁওবুড়োর সঙ্গে সঙ্গে বাদাবনের মা ও বিশ্বাস করেন, “বাঘ থাকলে জঙ্গল থাকবে, জঙ্গল থাকলে আমরা বাঁচব।”
শুভ বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবস!
সূত্র: “বোনবিবি জহুরা নামা” – মোহাম্মদ খাতের
“সুন্দরবনের ইতিহাস”- কানাইলাল সরকার।