সাম্যব্রত জোয়ারদার: সুরু নদী বইছে। বেশ শব্দ হচ্ছে। হু হু করে নেমে চলেছে নীচের দিকে। বিকেলের দিকে হাওয়ায় যেন তোলপাড় পরিস্থিতি। কারগিলে যেখানে দাঁড়িয়ে তার এক হাত দূরে সুরু। একটু এগিয়ে রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। জলের তুমুল গতির যে শব্দ, তা আরও জোরালো হল।
আরও পড়ুন- কার্গিল যুদ্ধের গল্প
অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এসে সুরু কারগিলে এসেছে। এরপর এগিয়ে গিয়েছে আরও উত্তরে। পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের স্কারদুর দিকে। মীর সাব বললেন, প্রতি বছরই কেউ না কেউ ভেসে যায়। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় এলওসি পার করে কোনও দূরের গ্রামে। এখান থেকে লাইন অব কন্ট্রোল খুব বেশি দূরে না। আরও খানিকটা গড়িয়ে সুরু পড়েছে সিন্ধু নদে।
আরও পড়ুন-‘LOC কার্গিল’-এর দিনগুলো
১৯৯৯ সালের কথা। খবরের কাগজে চাকরি করি। ছোট কাগজ। বেতন কম। কিন্তু দায়িত্ব অনেক। খবর ঝাড়াই বাছাই থেকে শুরু করে, স্পাইক করা, লিড বাছাই সবই করতে হচ্ছে। নিউজ এডিটর সন্ধের পর থেকেই তাড়া দিতেন। লিডটা কিন্তু তুই লিখে দিবি।এ রকমই একটা দিন হাতে এসে পড়ল টেলিপ্রিন্টারের একটা খবর। কারগিল পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়েছে মুজাহিদিনরা। যাদের গায়ে পাক সেনার পোশাক।
আরও পড়ুন-স্বর্ণমন্দিরে রচনা
কারগিলের চায়ের বেশ নামডাক শুনেছিলাম। বাজারের ভিতর দিয়ে রাস্তা। বাঁ-দিকে গুরুদ্বার, তার পাশেই একটা মসজিদ। মাঝে একটাই দেওয়াল। তার ডান পাশ দিয়ে রাস্তা উপরের দিকে উঠেছে পুরনো শহরের দিকে। ওই দিকেই মিউজিয়াম। কারগিল শহরের প্রাচীন সংগ্রহশালা। শহরের উপর দিয়েই গিয়েছে ঐতিহাসিক সিল্ক রুট। মিউজিয়ামের ভিতর সেই অতীতকালের গন্ধ। পুরনো পুঁথি। বাদ্যযন্ত্র। সুরু নদীর ধারে কারগিল শহরের সাদা-কালো ছবি। বোঝা যায় শহরটা এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। পাহাড়ের উঁচুর দিকে এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস। এখানে দাঁড়িয়ে সুরু নদীর পাশে আলোর মালার মতো জড়িয়ে থাকা কারগিল শহর।
আরও পড়ুন-ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির বিচার্য বিষয় নির্ধারণ করতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হাইকোর্ট
কাওয়া চায়ে চুমুক দিলাম। অদ্ভুত স্বাদের। বেরাদরি করার নিয়মে এখানে এই কাওয়া চায়ের ব্যবস্থা। চুমুক দিলেই শরীর গরম। দোকানের মালিক বললেন, ‘এটা অনেকটা গ্রিন টি-এর মতো।’ জাফরান, বাদাম আরও বেশ কিছু মশলা দিয়ে তৈরি। হলুদ রংয়ের।
দ্রাস শহরে ঢুকে বাজার থেকে সিগারেট কিনে খেত পাক সেনা আর মুজাহিদিনরা। এটা কারগিলের লোকেরাই বলেছেন। কারও যে সন্দেহ হয়নি তা না। ভাষাগত মিল থাকলেও কথা বলার টান আলাদা। গোটা কাশ্মীরেই অন্তত পাঁচ-ছ’টা ভাষায় সাধারণ মানুষ কথা বলে থাকেন। লাদাখের ভাষার সঙ্গে শ্রীনগরের মিল নেই। মুজাহিদিনদের মুখে ছিল দ্রাস-কারগিল-বাটালিকের ভাষা। পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল পরভেজ মুশারফ যে কারগিল যুদ্ধ চলাকালীন স্কারদুতে এসেছিলেন, তার প্রমাণ রয়েছে। কারগিল শহরের লোকেরা বলে থাকেন ‘মুশারফের বিমান নাকি লাইন অফ কন্ট্রোল পার করে কাশ্মীরে ঢুকে পড়েছিল। ভারতীয় বাহিনী কিছু করে ওঠার আগেই বিমান নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে।’ সেই রাতের অন্ধকারে কারগিলে শহরের আকাশ ঝকঝক করছে। অসংখ্য তারা। মীর সাব বললেন, ‘জানেন সুরু নদীতেও পাক গোলা এসে পড়েছিল।’ কারগিল থেকে দ্রাস শহর যাওয়ার পথে এখনও লেহ্-শ্রীনগর জাতীয় সড়কের ডানদিকে একটা অংশ, উঁচু প্রাচীর দিয়ে আড়াল করা। পথের ওই অংশটুকু শত্রুর সরাসরি নিশানার মধ্যে পড়ে।
আরও পড়ুন-ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে জট কাটল না হাইকোর্টে
ওই ১৯৯৯ সালেই প্রথম শুনেছিলাম নিয়ন্ত্রণরেখার কথা। শুনেছিলাম পাহাড়ের মাথায় একাধিক পয়েন্টে পাক সেনারা ডেরা বেঁধেছিল শীতের অনেক আগেই। শ্রীনগর থেকে লেহ্, এই গোটা সড়ক পথের সমস্ত গতিবিধি পাহাড়চূড়া থেকে নজরবন্দি রেখেছিল পাক সেনা আর মুজাহিদিনরা। সেনাবাহিনীর প্রত্যেক ইঞ্চির গতিবিধি আগে থেকেই বুঝে নিত পাকিস্তান। মেষপালকেরা প্রথম এসে খবর দেয় সেনাবাহিনীর কাছে। সেনা নোট পাঠায় দিল্লিতে কেন্দ্রের কাছে। কিন্তু তৎকালীন বিজেপি সরকার প্রথমে ঘটনার গুরুত্ব দেয়নি। আর তাই হয়ত যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া। ৯ জুন, ১৯৯৯। সৌরভের দেহ ফেরত দেয় পাকিস্তান।
আরও পড়ুন-প্রাক্তন সেনাকর্মী থেকে RAW এজেন্ট, আড়ি পাতা তালিকায় নিরাপত্তারক্ষীরাও
কাকসার এলাকায় তল্লাশি অভিযানে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন শত্রুদের হাতে। সঙ্গে ছিলেন আরও ৫ সহযোদ্ধাও। সৌরভ কালিয়ার দেহ দেখে শিউরে উঠেছিল সেনাবাহিনী। সারা শরীরে ছেঁকার দাগ। কানের ভিতর গরম লোহা ঢুকিয়ে দেওয়ার চিহ্ন। ভাঙা চোয়াল, খুবলে নেওয়া চোখের মণি। ভাঙা দাঁত, হাঁড়। ছিঁড়ে নেওয়া ঠোঁট আর শিশ্ন।
আরও পড়ুন- কার্গিল বিজয় দিবস: খারাপ আবহাওয়ার কারণে বাতিল রাষ্ট্রপতির লাদাখ সফর
লাইন অব কন্ট্রোলের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে। নীচে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গ্রাম। উঁচুতে পাক বাহিনীর পোস্ট। সাদা বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। মীর সাব বললেন, ‘পাকসেনারা সব নজর রাখছে। বাইনোকুলারে চোখ রেখেছে। আমাদের জামার রং কী, গাড়ির নম্বর কত সব টুকে রাখছে।’ রাস্তার দু’ধারে ‘লেখা মাইন পাতা আছে সাবধান। রাস্তা ছেড়ে বাইরে নামবেন না।’ ১৯৬৫ সালের নির্দেশ। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের আগে এলাকাটা পাকিস্তানের দখলে ছিল। পঁয়ষট্টির যুদ্ধে সেনাবাহিনী এলাকা উদ্ধার করে। নীচেই একটা গ্রামের ধ্বংসস্তূপ। মানুষ নেই। ঘর গেরস্থালি সব ফাঁকা পড়ে। পায়ে পায়ে গ্রামের দিকে এগোতে থাকলাম। সুরু নদী শব্দ করে বইছে।