চরাচর যেন রামগরুড়ের ছানাদের চারণভূমি। হাসি নেই, ব্যঙ্গ নেই, শ্লেষ নেই। একটা হাসিই বেঁচে আছে—-কাষ্ঠহাসি। ‘মাসিমা মালপো খামু’র যুগ বিলকুল ধাঁ।
শিল্পীর হাতে প্যালেট, তাতে হরেক রঙ মাখানো। সামনে রাখা ছোট্ট ক্যানভাস। তুলির টানে ক্যানভাসে কয়েকটি আঁচড়। তৈরি কার্টুন।
হাসি মজার কত কিছুই থাকত কার্টুনে। দেখলেই ঠোঁটের ডগায় হাসি। নিশ্চয়ই ভাবছেন, থাকত কেন বলছি। কারণ, হাসি মজা আজ জীবন থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে বললেই চলে। শুধুই কি কার্টুন? না, হারিয়ে গেছে মজার সিনেমা থেকে হাসির গল্পের বই। আজ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে জহর রায়, তুলসী চক্রবর্তী থেকে রবি ঘোষ বা অনুপকুমার—কেউই আর নেই। তাই হাসি-মজাও জীবন থেকে লোটাকম্বল গুটিয়ে চলে গেছে বলা যায়।
চণ্ডী লাহিড়ি ও তাঁর কার্টুন
দৈনিক, বিশেষত শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাতে একটা সময় প্রথম পাতায় নিয়মিত কার্টুন প্রকাশিত হতো। সেগুলো নিয়ে আলোচনাও কম ছিল না। কিন্তু এখন আর পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় কার্টুন, বিশেষ করে রাজনৈতিক কার্টুন প্রকাশিত হয় না। রাজনৈতিক কার্টুন এখন শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে।
কার্টুন শব্দটা ইংরেজি। বাংলায় যাকে বলে ব্যঙ্গচিত্র। এমন এক চিত্র যা হাজার শব্দের পরিপূরক। যার মধ্য দিয়ে অনেক কঠিন বিষয়কেও সহজভাবে উপস্থাপন করা যায়। মধ্যযুগে ইতালিতে চিত্রকরদের দেওয়ালে ছবি আঁকার সময় আলাদা আলাদা স্কেচের মধ্যে দিয়ে নির্দেশনা দেওয়ার রীতি ছিল। এই স্কেচগুলিকে বলা হত কার্টোনি। যা থেকেই এসেছে কার্টুন।
কার্টুনিস্ট কুট্টি ও তাঁর কার্টুন
পূর্বে রাজনৈতিক-সহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর কার্টুন আঁকা হত। তবে, সংবাদপত্রে সাধারণত রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুন ও স্ট্রিপ কার্টুন বেশি ব্যবহৃত হত। যুগান্তর, আনন্দবাজার, আজকাল, বর্তমানে নিয়মিত কার্টুন প্রকাশিত হতো। সেই সময় কার্টুনিস্টরা তাঁর কার্টুনের মাধ্যমে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করতেন। কার্টুনে শুধু ব্যঙ্গবিদ্রুপ নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও থাকত।
একটি পত্রিকায় কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে, কার্টুনশিল্পীরা আক্রান্ত হয়েছেন। বারবার প্রশ্ন উঠেছে কার্টুনশিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে। ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, হিউমার যত সূক্ষ্ণ হবে ততই উঁচু দরের শিল্পের পর্যায়ে তা স্থান পাবে। কার্টুন যেমন ক্ষমতাসীনরা পছন্দ করেন না, তেমনই সমালোচনাও সহ্য করেন না। পশ্চিমবঙ্গে কার্টুনশিল্পী চণ্ডী লাহিড়ির সরকার প্রদত্ত সাংবাদিক পরিচয় বাতিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাঁর আঁকা কার্টুনে ক্ষুব্ধ।
কার্টুনশিল্পী চণ্ডী লাহিড়ি
কার্টুনের সঙ্গে ক্ষমতার বিরুদ্ধাচারণের সম্পর্ক অনেকদিনের। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে পরবর্তী কালের বিজয় নারায়ণ শেঠ, অমল চক্রবর্তী। স্বাভাবিক কারণেই ব্যঙ্গচিত্র-শিল্পীদের নানা সময়ে শাসকের রক্তচক্ষু সহ্য করতে হয়েছে। এখনও হচ্ছে। ব্যঙ্গচিত্র আঁকার দায়ে অবিভক্ত ভারতের এক প্রবাদপ্রতিম বাঙালি কার্টুনিস্ট সরকারি চাকরি পর্যন্ত খুইয়েছিলেন। আমরা যাঁকে সুফি নামে চিনি। প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ রায়। কাফি খাঁ (প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ি)-র পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে দক্ষ কার্টুনিস্ট সুফি। যুগান্তর, গণশক্তি, দৈনিক ও মাসিক বসুমতি, সচিত্র ভারত প্রভৃতি বহু পত্রিকায় কার্টুন এঁকেছেন। কার্টুন হল ছবি আঁকা-আঁকির আবেদনপূর্ণ ধারা। এক কথায় বলতে গেলে, কার্টুনের রয়েছে এক প্রতিবাদী চরিত্র। কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ি বলতেন, ‘গোটা সোশ্যালিস্ট আন্দোলনটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে কার্টুনের উপর।’
নারায়ণ দেবনাথ বাঙালিকে দিয়েছে নিজস্ব বাঙালি কার্টুন। বাংলা কমিকস জগতের একচ্ছত্র আধিপত্য তাঁর। হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, আরও কত নাম, কত রকমের ভঙ্গি। তুলির টানে এঁকেছেন নারায়ণবাবু।
আগে প্রথম পাতায় লিড নিউজের সঙ্গে একটা কার্টুন থাকতই।বর্তমানে সংবাদপত্রে কার্টুন নেই বললেই চলে।কখনও রাজনৈতিক চাপ, কখনও তীব্র সমালেচনার ঝড়। বিশিষ্ট কার্টুনিস্ট শৈল চক্রবর্তীর ছেলে অভিনেতা চিরঞ্জিত চক্রবর্তী বললেন, কার্টুনের যুগ আজ প্রায় শেষের মুখে। কার্টুনে অনেক মুভমেন্ট এসেছে। খবরের কাগজের কার্টুনে আজকাল আর মানুষের চোখ যায় না। ফলে, মনোযোগও বেশ কমেছে বলা চলে। যেহেতু কার্টুন অডিও-ভিজুয়াল হয়ে গেল তাই শুধু একটা ছবির প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকল না।
একটা সময় কার্টুন সম্রাট বলা হত শৈল চক্রবর্তীকে। তাঁকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল কার্টুন সম্রাট। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শৈল চক্রবর্তী কার্টুন আঁকা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নই উঠে এসেছিল ছেল চিরঞ্জিতের কাছ থেকেই। উনি বলেছিলেন, লোককে নিয়ে এই যে ব্যঙ্গ বা হাসা, ক্যারিকেচার করা এইটা একটা সময়ের পরে আর করা যায় না। এটাই মজা। খুব নামী অভিনেতাও প্রথম দিকে কমেডি সিনেমা করতে পারে কিন্তু একটা সময়ের পরে গিয়ে আর করে না। কমেডি থেকে ফিরতে চায় সিরিয়াস ছবিতে।
কার্টুনিস্ট : শৈল চক্রবর্তী , চিরঞ্জিত চক্রবর্তী
কার্টুন শেষ হওয়া নিয়ে চিরঞ্জিত বলেন, ”কার্টুন শেষ হয়নি। পাল্টেছে তার রূপ। স্টিল ছবি থেকে মুভিতে চলে গেছে কার্টুন। ‘একটা সময় সন্দেশের কভার পেজ করেছিলাম স্ট্রিপ কার্টুন দিয়ে। সেরকম জিনিস এখন আর মানুষ উপভোগ করে না।” তিনি বলেন, একটা সময় অমৃতবাজার, শ্রেষ্ঠ ভারতে প্রচুর কার্টুন এঁকেছেন। অভিনেতা হিসেবে সবাই তাঁকে চিনলেও, অনেকেই জানেন না, তিনি একজন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট। সিকিম ডকুমেন্টরি করতে যাওয়ার সময় মানিকবাবুর ইচ্ছে ছিল স্ট্রিপ কার্টুনে কভার পেজ হবে।আর তা করবেন আর কেউ নয়, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। সেই মতোই মাত্র ১৮ বছর বয়সেই বানিয়েছিলেন স্ট্রিপ কার্টুন। তাঁর কথায়, ”বাবা যেমন আঁকিয়ে ছিলেন, মানিকবাবুও ছিলেন ভীষণ ভালো আঁকিয়ে। সেই যুগ আর নেই।”
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি এখন ছবি আঁকেন কি না জানতে চাওয়ায় বলেন, মাঝে মধ্যেই ছবি আঁকেন, কভার পেজও করে দেন। এখন কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা নেই। কুট্টি, শংকর ওঁরা যেভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছেন, এখন তা নেই। রাজনীতির ভয়ে এখন কার্টুন সবাই নিতেও পারে না।
কার্টুনিস্ট উদয় দেব বলেন, কার্টুনে নিউ ইয়র্ক টাইমস ছিল স্বর্গ। সেই নিউ ইয়র্ক টাইমস বন্ধ করে দিল কার্টুন বিভাগ।এই চিত্র কেবল ভারতে নয়, বাইরেও। দিনের শেষে সেই সম্পাদকীয় নীতি বেঁধে দিয়েছে হাত। কী আঁকবে, আর কী আঁকবে না। দুটো দিক থেকে ভাবলেই বিষয়টা পরিষ্কার। একটা মালিকপক্ষের দিক থেকে ভাবা, আর একটা কর্মীদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা। সবসময় একজন কার্টুনিস্ট নিজে যা চায়, যেভাবে চায় তা করতে পারে না। কারণ, ক্ষমতা চায় অন্যভাবে করুক কাজটা কার্টুনিস্ট।
বোঝাই যাচ্ছে, ক্ষমতার দম্ভের কাছে ক্রমশ খেই হারিয়ে ফেলেছে কার্টুন-শিল্প।। তবে লম্বা নাকের বিচিত্র সব কার্টুন আজও হয়ে রয়ে গেছে বাঙালির মনে। কার সাধ্য তাকে টলায়।