অতএব ইউরো কাপের শেষ আটে ব্রাহ্মণদের অনেককেই দেখা যাবে না। ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগালের মতো চ্যাম্পিয়ন টিমগুলো প্রিকোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিয়েছে। বড় টিমগুলোর মধ্যে বেঁচে আছে শুধু ইতালি, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং স্পেন। শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা। প্রথম দিন থাকছে দুটো ম্যাচ। স্পেন খেলবে সুইৎজারল্যান্ডের সঙ্গে। দিনের দ্বিতীয় ম্যাচে ইতালির সামনে বেলজিয়াম। শনিবারের দুটি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের প্রথমটিতে ডেনমার্ক খেলবে চেক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে। দিনের দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের সামনে ইউক্রেন।
১৯৯২ সালে কাউকে কিছু আগাম কল্পনা করতে না দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ডেনমার্ক। আর ২০০৪ সালে শতাব্দীর সেরা বিস্ময় ছিল গ্রিসের চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এবার বড় দলগুলোর মধ্যে কোয়ার্টার ফাইনালে একটা বড় দলের বিদায় অবধারিত। ইতালি ও বেলজিয়ামের মধ্যে একটা দলকে তো হারতে হবেই। তার পর পুরনো রেকর্ড দেখলে সেমিফাইনালে যাওয়ার কথা স্পেন, ইংল্যান্ড ও ডেনমার্কের। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবে স্পেন হারিয়েই দেবে সুইৎজারল্যান্ডকে? কিংবা চেক প্রজাতন্ত্রকে হারাবে ডেনমার্ক? অথবা ইংল্যান্ডকে হারিয়ে অঘটন ঘটাবে না ইউক্রেন?
কী হবে সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যা হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা তো করাই যায়। ইদানীং কালের সবচেয়ে বড় অঘটনটা ঘটিয়েছে সুইৎজারল্যান্ড। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিরতির আগে তারা এক গোলে এগিয়ে ছিল। এটা হতেই পারে। কিন্তু বিরতির পর ফ্রান্স যখন পর পর তিনটে গোল করল, তখন ভাবা অসঙ্গত ছিল না ম্যাচটা ফ্রান্সই জিতবে। বিশেষ করে পল পোগবার ওই রকম বিশ্ব মানের গোলের পর সেই টিম ম্যাচ হারবে তা কল্পনার বাইরে। আশি মিনিট পর্যন্ত ফ্রান্স ৩-১ গোলে এগিয়ে এবং ম্যাচ তো ওখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। দশটা মিনিট দু গোলের লিড ধরে রাখতে পারবে না বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা? এটাও দেখতে হল। সুইৎজারল্যান্ডের অনামী ফুটবলাররা মনে হয় ইদানিং কালের সবচেয়ে বড় অঘটনটা ঘটিয়েছেন। কোনও প্রশংসাই তাদের জন্য যথেষ্ট নয়।
ফ্রান্সের এই অপ্রত্যাশিত হারের জন্য কোচ দিদিয়র দেশঁর সমালোচনা করা হচ্ছে। এই লোকটা ফ্রান্সের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন টিমের অধিনায়ক। আবার কোচ হিসেবে দেশকে ইউরোর রানার্সের পাশাপাশি বিশ্ব কাপ চ্যাম্পিয়নও করিয়েছেন। তাঁর এবারের টিম আর দশটা মিনিট কাটাতে পারলেই তো এত সমালোচনা হত না। বিশ্ব কাপের নায়ক কিলিয়ান এম্বাপে টাই ব্রেকারে পেনাল্টি মিস করলেন। এটা হতেই পারে। কিন্তু রাশিয়া বিশ্ব কাপের নায়ক এম্বাপের এবারের ইউরোতে গোল নেই এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। এটাই ফুটবল। কিন্তু এর সঙ্গে দেশঁ কেন তিন ব্যাকে খেললেন তা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। তবে ৩-১ এগিয়ে যাওয়ার পর বাকি দশ মিনিট ডিফেন্সে লোক বাড়িয়ে ফেললেই চলত। দেশঁ কি একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিলেন? হতেই পারেন। কিন্তু তার বড় খেসারত দিতে হল তাঁকে। একটা চ্যাম্পিয়ন টিম দশ মিনিটের গাফিলতিতে বিদায় নিল টুর্নামেন্ট থেকে। এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে।
মারণ গ্রূপ থেকে নক আউটে যাওয়া ফ্রান্স, জার্মানি ও পর্তুগাল কেউ আর নেই ইউরোতে। তবে জার্মানি ও পর্তুগালের বিদায়ের মধ্যে তেমন অঘটন কিছু নেই। জার্মানি এবং পর্তুগাল দুটো টিমই হেরেছে বড় টিমের কাছে। ইংল্যান্ডের কাছে জার্মানি। বেলজিয়ামের কাছে পর্তুগাল। বেলজিয়াম ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর টিম। তারা হয়তো অনেক দূর যাবে। বা ইতালির কাছে হেরে বিদায়ও নিতে পারে। তাতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। তাই তাদের কাছে পর্তুগালের হারটাও অস্বাভাবিক নয়। তবে সে ম্যাচে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে সেভাবে পাওয়া যায়নি। এবারে রোনাল্ডো পাঁচটি গোল করে এখন পর্যন্ত টপ স্কোরার। শেষ পর্যন্ত অন্য কেউ সেই সম্মানটা দখল করতেই পারেন। চেক প্রজাতন্ত্রের প্যাট্রিক সিক তো চারটে গোল করে ফেলেছেন। কিন্তু টপ স্কোরার হোন বা না হোন যে রোনাল্ডোকে আমরা দেখতে চেয়েছিলাম সেই রোনাল্ডোকে পাওয়া যায়নি। ফুটবল তো এগারোজনের খেলা। কিন্তু কোনও একজন বাকিদের ছাপিয়ে যান বলেই তিনি মহাতারকা। রোনাল্ডো সেই বিরল প্রজাতির খেলোয়াড়। পর্তুগালের বিদায়ের চেয়েও রোনাল্ডোর নিষ্ক্রমণ তাই আরও বেদনার।
ইংল্যান্ডের কাছে জার্মানির হারকে অঘটন বলা যাবে না। দুটোই বড় টিম। ইংল্যান্ড ওয়েম্বলিতে খেলার সুবিধে পেয়েছে। দুই টিমের ঐতিহাসিক রেষারেষির কথা সর্বজনবিদিত। তবে জার্মান সমর্থকরা হতাশ হতেই পারেন তাদের টিম নিজেদের সেরা খেলা খেলতে পারেনি। ইংল্যান্ড গোল করার আগে দিনের সহজতম সুযোগটি হারিয়েছেন টমাস মুলার। এটা হতেই পারে। ফুটবলে গোলের মতো গোল মিসও খেলার অঙ্গ। ওই গোলটা হয়ে গেলে ম্যাচের ফল কী হত তা অনুমানের বিষয়। কিন্তু ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারাতে গেলে যে দাপট দেখাতে হয় তা টনি ক্রূস, জসুয়া কিমিচ কিংবা রবিন গোসেন্সরা দেখাতে পারেননি। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে টিমো ওয়ের্নার চুড়ান্ত ব্যর্থ। জোয়াকিম লো-কে প্রশ্ন করাই যেতে পারে এ রকম একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সার্জ নাব্রিকে বসিয়ে টিমো ওয়ের্নারকে নামানোর যৌক্তিকতা কী? এ সব প্রশ্ন করা এখন নিরর্থক। কারণ জার্মানির বিদায় ঘটিয়ে দিয়েছে ইংল্যান্ড, যারা গতকাল চার ব্যাকে না খেলে তিন ব্যাকে খেলেছে। সাউথগেট যদি হারতেন তাহলে তাঁর স্ট্র্যাটেজি নিয়ে প্রশ্ন উঠত। জিতে গেছেন, তাই তিনি সফল। দেশঁ হেরে গেছেন তাই তাঁর রণনীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অবাক হতে হল চেক প্রজাতন্ত্রের কাছে নেদারল্যান্ডসের হার দেখেও। ৫৫ মিনিটে ডাচদের একটা লাল কার্ডই ম্যাচটা শেষ করে দেয়। ম্যাথিয়াস ডিলিটের লাল কার্ড দেখার পর দুটো গোল করে ফেলল চেক-রা। এটাও একটা বড় অঘটন। ডাচরা এবার ভালই খেলছিল। কিন্তু দশ জনে খেললেই কী হারতে হবে? আসলে যেটা শুরু থেকেই বলতে চাইছি তা হল বড় দলগুলির দাদাগিরি আর ছোট দলগুলি মানতে চাইছে না। ব্রাহ্মণদের দিন মনে হয় ফুরিয়ে আসছে। তবু রক্ষে এখনও স্পেন, ইংল্যান্ড, ইতালি ও বেলজিয়াম টিকে আছে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অধিকার সবারই আছে। ওই চার দলের বাইরে যে চার দল আছে সেই সু্ইৎজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, চেক প্রজাতন্ত্র কিংবা ইউক্রেনের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অধিকার আছে। এরা যদি ব্রাহ্মণদের হটিয়ে দেয় তাহলে অবাক হলেও মেনে নিতে হবে।
কারণ আপনি মানুন অথবা না মানুন ইউরোতে ব্রাহ্মণদের রাজত্বের অবসান হওয়ার ইঙ্গিত কিন্তু ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।