এ-মাসের শুরুর দিকে, গুয়াহাটি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ একটি আদেশে বলেছিল ‘…নাগরিকত্ব, একজন ব্যক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার ।’ আদালত আসর উদ্দিনের মামলার শুনানির সময় এই মন্তব্য করেছিল । যে আসর উদ্দিনকে বিদেশি ট্রাইব্যুনালের এক আদেশের মাধ্যমে অনুপস্থিতিতে ‘বিদেশি’ নাগরিক বলে ঘোষণা করেছিল । এই খবরটিকে উল্লেখ করে এই ইংরাজি সংবাদ মাধ্যম তাদের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সাধারণভাবে, এটি বড় খবর হওয়া উচিত নয় । প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নাগরিকত্ব প্রকৃতপক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার, প্রকৃতপক্ষে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার । কারণ, এটি অন্য অধিকার পাওয়ার অধিকার । কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলি নাগরিকত্বের সঙ্গে এমন আচরণ করে না । অসমে, সজ্জিত সেনা কর্মকর্তা-সহ যে কোনও ব্যক্তিকে ‘অ-নাগরিক’ বলে অভিযুক্ত করা যেতে পারে । প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হাই কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ টাটকা বাতাসের শ্বাসের মতো ।
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন পূর্ব ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছে । মূলত অসম, ত্রিপুরা এবং শিলংয়ে বিক্ষোভ দেখা গেছে । এই আইনে দু’ধরনের মতামত আছে । সমর্থকরা বলছেন, সিএএ হল অতীতের অন্যায় কাজের সংশোধন । অন্যদিকে, বিরোধীরা বলছেন এটা হল ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজনের একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত । ১৯৯৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে যাঁরা ভারতে বেআইনি পথে কোনওরকম নথি ছাড়া প্রবেশ করেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিলের কথা বলা হয়েছে ।
আরও পড়ুন: মোদির জন্মদিনে টিকাকরণের পরিসংখ্যানে ব্যাপক কারচুপি, টিকা পেয়েছেন ‘মৃত’ মহিলাও
নিজেদের জীবন সুন্দর এবং স্বচ্ছন্দময় করার জন্য মানুষ অন্য দেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করেন এবং উদ্বাস্তু হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন । ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১.৫ কোটি মানুষ দুই দেশের সীমান্ত টপকে ছিলেন। ভারত-পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে ১.২ কোটি মানুষ এবং পূর্ব সীমান্তে ৪২ লাখ মানুষ সীমান্ত পারাপার করেছিলেন । দেখা গিয়েছে, ১৯৫৯ সালের পর থেকে ৮০ হাজার তিব্বতের মানুষ ভারতে প্রবেশ করেছেন ৷ একইরকমভাবে বৌদ্ধ গুরু তথা ধর্ম প্রচারক ১৪ তম দলাই লামা নিজেও ভারতের শরণার্থী ৷
উাগান্ডায় ১৯৭২ সালে কিছু ভারতীয় নির্যাতনের স্বীকার হন এবং পরবর্তী সময় এক লাখের বেশি তামিল শ্রীলঙ্কা থেকে শরণার্থী হিসেবে থেকে যায় ৷ তবে নতুন আইনে এই সব শরণার্থীদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই, সব সমস্যা ওই তিন মুসলিম রাষ্ট্রের শরণার্থীদের নিয়েই ৷ দেশভাগের সময় পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকায় মানুষগুলির নির্যাতনের সম্মুখীন হন ৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা ভারতে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করেন ৷ যেখানে শিখ এবং হিন্দুরা তাদের স্থান বদল করে নিয়েছেন, সেখানে মুসলিমরা পরবর্তী কালে ফিরে গেছেন ৷ তবে পূর্ব সীমান্তবর্তী এলাকার অবস্থা ছিল ভয়ঙ্কর ৷ পরবর্তীতে পরিস্থিতি বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়ে যায়৷ পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাংলাদেশের এক লাখের বেশি মানুষ ভারত এবং বাংলাদেশে তাঁদের আশ্রয় খুঁজে নিতে চান ৷ শরণার্থী হিসেবে এই অনুপ্রবেশ এখনও চলছে ৷
আরও পড়ুন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি পুলিশি, শর্টস পরে আসায় অসমে পরীক্ষা দিতে বাধা পড়ুয়াকে
মোটামুটি ২.৪০ কোটি অবৈধ অভিবাসী ভারতে রয়েছে ৷ এর মধ্যে বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে, অসমও বাদ পড়েনি ৷ দেখা দেখে, ৭৫ লাখ অবৈধ অভিবাসী পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে, বাকি অসম এবং ত্রিপুরায় ৷ এর মধ্যে অসমের স্থান দ্বিতীয় ত্রিপুরা তৃতীয়৷ জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে ৭-৮ লাখ অবৈধ অভিবাসীদের দেখা গেছে ৷ এখান থেকে তারা উত্তরপ্রদেশ, কেরল এবং হায়দরাবাদে ছড়িয়ে পড়ে ৷ এটা প্রথম থেকেই দেখা গেছে যে, অসম প্রথম থেকে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ৷ অভিবাসীদের মধ্যে হিন্দুর পাশাপাশি মুসলিমদের সংখ্যাও প্রতি নিয়ত বেড়ে চলেছে৷ এই সংখ্যাটা ২৫ লাখ থেকে বেড়ে ৩৫ লাখ হয়ে গিয়েছে ৷ তাদের নিজস্ব জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার পর অসমের মানুষ জন তাঁদের মাতৃ ভাষাকে রক্ষা করতে প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু করে ৷
অসমের এনআরসি-র নবায়নের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত খসড়ায় ৯০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছিল। ৩০ জুলাই, ২০১৮-র দ্বিতীয় খসড়ায় ৪০ লক্ষের নাম, এবং ৩১ অগস্ট, ২০১৯-এ এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকার সময় এনআরসি-ছুটের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৯৬,৬৫৭! প্রায় দু’বছর হতে চলল এনআরসি-ছুটদের এখনও ‘রিজেকশন স্লিপ’-সহ ‘স্পিকিং অর্ডার’ দেওয়া হয়নি, যেখানে নাম না আসার কারণ উল্লেখ থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার আগেই অসমের এনআরসি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিল, ২০২০ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে এনআরসি-র কাজ শেষ করতে হবে। সেই কাজ শেষ করা তো দূরস্থান, এখনও শুরুই করা যায়নি। নতুন ২০০টি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তৈরির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। অসম সরকার তাদের পছন্দমতো ২০০ সদস্যকে নিযুক্ত করেছিল ২০১৯ সালে, যাঁদের মাসিক বেতন ৯০,০০০ টাকা। বিভিন্ন মহকুমার এনআরসি-ছুটদের জন্য পৃথক পৃথক ফরেনার্স ট্রাইবুনালের অফিসও সরকার ভাড়া নিয়েছিল। এই ২২ মাসে সরকারের খরচ হয়েছে কম করে ৫০ কোটি টাকা! অথচ কাজের পরিসংখ্যান, এক কথায়, ‘বিগ জ়িরো’।
আরও পড়ুন: মহিলাদের উপরে হওয়া অপরাধে টানা চার বছর ধরে শীর্ষে অসম
করোনা পরিস্থিতিতে দেশে বেকারত্বের হার ক্রমশ বাড়ছে । এই পরিস্থিতিতে অসমে এনআরসি পরবর্তী কাজকর্মের জন্য টাকা খরচ করার কোনও যুক্তি আছে কি ? এ কেবল অর্থহীন নয়— অনৈতিক। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি নতুন কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢোকানো হয়, তার মেয়াদ হবে বড়জোর তিন বছর। তার পর তাঁরা জামিনে মুক্তি পাবেনই, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকার ও অসম সরকারের এখন উচিত, অকাজে সময় ও সম্পদ নষ্ট না করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনীতিকে মজবুত করার দিকে নজর দেওয়া ।