কলকাতা: মুক্তিপণের ২৫ লক্ষ টাকা হাতে পাওয়ার পর থেকেই পুলিসকে বারংবার ধোঁকা দিয়েছে লি রোডের স্বর্ণ ব্যবসায়ীর খুনি। ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, ওডিশার বিভিন্ন জায়গায় বেনামে বিভিন্ন হোটেলে ঘুরে বেরিয়েছে। শুধু তাই নয়, পরিচয় লুকোতে মোট ৯ বার নাম বদল করেছে অভিযুক্ত বিমল শর্মা। নিজের লুকসও বদলেছে। আদতে নয়াদিলির বাসিন্দা বিমলের নামে একাধিক মামলাও রয়েছে দিল্লিতে। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে তাড়া করে কয়েক সপ্তাহ পর শেষ পর্যন্ত তাকে আহমেদাবাদ থেকে গ্রেফতার করে পুলিস।
১৪ ফেব্রুয়ারি। ঘড়ির কাঁটায় রাত ৯টা ৪০ মিনিট। ২৫ লক্ষ টাকার একটা ব্যাগ নিয়ে অপহৃত স্বর্ণ ব্যবসায়ী শান্তিলাল বাইদের পরিবার পৌঁছে যায় ভিক্টোরিয়ার দক্ষিণ গেটের সামনে। দূর থেকে অপহরণকারীর গতিবিধি দেখার জন্য আগেই মোতায়েন করা ছিল পুলিস ফোর্স। রাত ১০টা ২০ নাগাদ হলুদ ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। ভিতর থেকে অপহরণকারী টাকার ব্যাগ নিয়ে শান্তিলালের ফোন ফেরত দিয়ে দেয় পরিবারকে। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে যায়। পুলিস তাড়া করতে থাকে ওই ট্যাক্সিকে। আচমকা আরও দুটি হলুদ ট্যাক্সি এসে যায়। গোয়েন্দারা ভাবেন, বাকি দুটো ট্যাক্সি সঙ্গে যোগ আছে ওই অপহরণকারীর।
তিনটি ট্যাক্সি তিন দিকে চলে যায়। সেইমতো গোয়েন্দারা পিছু নেন ট্যাক্সিগুলির। তবে যেই ট্যাক্সিতে অভিযুক্ত বিমল ছিল, সেই ট্যাক্সি কিছুটা গিয়েই উধাও হয়ে যায়। একটা পয়েন্ট অবধি যাওয়ার পর আর সেটিকে ফলো করতে সক্ষম হননি গোয়েন্দারা। যে ট্যাক্সি করে বিমল হাওড়া গিয়েছিল, সেই ট্যাক্সিকে চিহ্নিত করে পুলিস। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। জানা যায়, হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছে অভিযুক্ত। তড়িঘড়ি হাওড়া স্টেশনে সিসিটিভি ফুটেজ দেখেন গোয়েন্দারা। সূত্রের খবর, ওই ট্রেনের টিটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, ফাইন দিয়ে ভুবনেশ্বরের টিকিট কাটে বিমল।
আরও পড়ুন: Bhowanipore Murder: অপহরণ-মুক্তিপণ-খুন, লি রোডের স্বর্ণ ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ড যেন ক্রাইম থ্রিলার
ভুবেনেশ্বর যাওয়ার আগেই সে মাঝপথে নেমে যায় ট্রেন থেকে। ঘুরপথে ভুবনেশ্বর পৌঁছয় বিমল। ততক্ষণে ভুবনেশ্বরের উদ্দেশে রওনা দিয়ে দিয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের একটি দল। ভুবনেশ্বর স্টেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন চেকপোস্ট, টোল প্লাজায় তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয় অভিযুক্তকে। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, ভুবনেশ্বরে অটো অ্যাসোসিয়েশন থেকে ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন, সবাইকে বিমলের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গোয়েন্দারা খবর পেয়ে একটি হোটেলেও যান। তবে সেখানে পৌঁছনোর আগেই অভিযুক্ত পালিয়ে যায়।
ভুবনেশ্বর পুলিসের কাছেও বিমলের ছবি পাঠানো হয়। কলকাতা পুলিশ ও ভুবেনশ্বর পুলিশের যৌথ অভিযান চলে। দেখা যায়, কোনও হোটেলেই স্থায়ী ভাবে থাকেছে না বিমল। অন্য অন্য নামে হোটেল বুক হচ্ছে এক বা দু-রাতের জন্য, অথচ সে থাকছে তিন বা চার ঘণ্টার জন্য। একইভাবে, বাসে নির্দিষ্ট একটি গন্তব্যে টিকিট কাটলেও মাঝরাস্তায় নেমে যাচ্ছে। ঘুরপথে সেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাচ্ছে। এইভাবে বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেরিয়েছে বিমল। হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি কলকাতা পুলিসও।
গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকজন দুঁদে অফিসারদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভুবেনেশ্বর লাগোয়া বেশ কিছু রাজ্যে। বিমলও পুলিসের কৌশল বুঝতে পেরে, কখনও ওডিশার কটকে, কখনও বা ভুবনেশ্বর, আবার কখনও উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ, ছত্রিশগড়, গুজরাতে। তদন্তকারী অফিসাররা গুজরাট এটিএস-এর সাহায্য নেন। জানা যায়, একটি কনসালটেন্সি এজেন্সিতে বিমল যায় চাকরির খোঁজে। সেখানেই একটি ফোন নম্বর দিয়ে বলে, যদি তার চাকরি হয়ে যায় তাহলে ওই নম্বরে ফোন করে জানাতে।
আরও পড়ুন: Businessman murder case: লি রোডে স্বর্ণব্যবসায়ী খুনে গ্রেফতার মূল অভিযুক্ত
গোয়েন্দাদের হাতে চলে আসে তুরুপের তাস। ওই কনসালটেন্সি এজেন্সির ম্যানেজারকে দিয়ে বিমলকে ফোন করায় পুলিস। তিনি বিমলকে বলেন, চাকরিটা হয়ে গিয়েছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন ম্যানেজার। তবে এই ফোনের পর গোয়েন্দারা একটু হলেও নিরাশা হয়েছিলেন বটে। কারণ যে নম্বরটা দিয়েছিল বিমল, সেটি এক অটো ড্রাইভারের। তবে ওই অটো ড্রাইভার বলেন, তিনি বিমলকে জানিয়ে দেবেন। কিন্তু আদৌ এই টোপ বিমল খাবে কি না, তা বুঝতে পারছিলেন না তদন্তকারী আধিকারিকরা।
ঠিক সেই সময় অভিযুক্তের লোকেশন দেখা যায়, মহারাষ্ট্রের শিরডিতে। তড়িঘড়ি সেখানে যান গোয়েন্দারা। তবে সেখান থেকে বিমল পালিয়ে যায় আহমেদাবাদে। অবশেষে গুজরাট এটিএস এবং কলকাতা পুলিসের যৌথ অভিযানে আহমেদাবাদ থেকে গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্ত বিমল শর্মাকে। এক তদন্তকারী আধিকারিক জানান, পুলিসকে ধোঁকা দিতে বেশ কিছু কৌশল নেয় বিমল। নিজের কোনও ফোন ব্যবহার করেনি সে। পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এক জায়গায় বেশি দিন থাকেনি। পুলিসের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য নিজের গোঁফ কেটে ফেলে। চুলের স্টাইলও চেঞ্জ করে বিমল।