একটি লোকের প্রতারণার টি টোয়েন্টি ব্যাটিং নিয়ে এখন গোটা রাজ্য মশগুল। মাঠের এমন কোনও দিক নেই, যেদিকে সে রান তোলেনি। পুলিশ যেদিকেই মাটি খুঁড়ছে, সেই গর্ত থেকেই একটি করে লোক ঠকানোর কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ছে। এই ব্যক্তি অপরাধী কি না, তা আদালতের বিচার্য। পুলিশ গোটা মামলার চার্জ গঠন কীভাবে করবে, তার ‘শিকার’রা আদালতে কতদিন, কতবার, কী ধরনের সাক্ষ্য দেবেন— তার ওপর নির্ভর করবে মামলার ভাগ্য। আর দিন কয়েকের মধ্যে মানুষ ভুলেও যাবে এই মামলার গতিপ্রকৃতি। যেমনটা প্রতি ক্ষেত্রে হয়। মানুষ অত কিছু মনে রাখে না। মনে রাখে না বলেই, খবর আসে, খবর যায়। ব্যক্তি চরিত্রের কলুষ শেষ পাতের চাটনির মতো। লাগে একটুখানি। তা দিয়ে পেট ভরে না।
আরও পড়ুন: টিকা নিয়ে ভয় কাটাতে ‘মন কি বাত’-এ বার্তা মোদির
কিন্তু রাষ্ট্রচরিত্র?
রাষ্ট্র যখন ছোবল মারে, তখন তাগা বাঁধি কোথায়! এদেশ জন্মের পর থেকে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে। সংবিধান হল তার প্রথম ও প্রধান দৃষ্টান্ত। ওই গ্রন্থটিকে খুঁড়োর কল করে এ যাবৎ দেশের মানুষকে ‘আন্তরিকতা’র সঙ্গে প্রতারিত করে চলেছে রাষ্ট্র। যে কারণে আজ পর্যন্ত সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার কি চাষাভুষো, মুটে-মজদুররা পেয়েছেন! নাকি কোনওদিন জানতেও পেরেছেন, এরকম কিছু ‘দান’ তাঁরা জন্মদিন থেকে ‘ভিক্ষা’ হিসেবে পেয়েছেন তাঁদের ভারতমাতার কাছ থেকে! তাহলে এই প্রতারণার দায় বর্তাবে কার ওপর? গরিব মানুষের তো একটা সুবিধা আছে, ‘প্রতারক’ হিসেবে অদৃশ্য ভগবান-আল্লার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ভাগ্যকে শাস্তি হিসেবে মেনে নিতে পারে। কিন্তু, সমস্যা হয় আমাদের মতো না-আস্তিক, না-নাস্তিক, শিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিতদের। যাঁরা বুঝতে পারি রাষ্ট্রীয় প্রবঞ্চনার কথা, কিন্তু কিছু করতে পারি না। পারি শুধু আলোচনার ছায়াযুদ্ধ চালাতে।
অতীতের বিষয় এখানে না টেনেই বলা যায়, কোভিড নিয়ে কি আমরা সত্যই কিছু জানতে পেরেছি? মৃতের সঠিক তথ্য? টিকাকরণের হিসাব? আর্থিক ক্ষতির পরিসংখ্যান? এরকম আরও কত কী! শুধু জানতে পাচ্ছি, আর্থিক বৃদ্ধি থমকে। চাকরি ও শিল্পের মন্দাদশা। কোষাগারে রাজস্ব ঘাটতি। আর এইসব তথ্য কপচে বিরোধী দলগুলি আদ্যিখেতার মতো আনন্দ পাচ্ছে ও সংবাদ মাধ্যমের সামনে নাচনকোঁদন দেখাচ্ছে। একবারও কেউ কি ভাবছে, এসব তথ্য গোপন সরকারি পাকশালায় রান্না করে, বিশেষজ্ঞদের নামের মোড়ক দিয়ে, বিরোধী হোম ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে বাজারিকরণ হচ্ছে কি না?
আরও পড়ুন: দেবাঞ্জনের বাড়িতে তল্লাশি, চাবি খুঁজছেন গোয়েন্দারা
সরকার নিজেকে ভিখারি বলে প্রমাণ করতে পারলে, দেশের মানুষের সেই ভিখারির কাছ থেকে কী আর পাওয়ার থাকতে পারে! শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান— পেয়ে গেলে তো তোমার বরাত। নচেৎ— ক্যায়া করে গা বাবু, গরিব আদমি হ্যায়। সুতরাং, কোভিড আছে তো শিক্ষা বন্ধ, চাকরি বন্ধ, কারখানা বন্ধ, খাবার, চিকিৎসা সবই বন্ধ। শুধু এখানে নয়, গোটা বিশ্ব জুড়েই। আমরা কোথাও প্রতারিত হচ্ছি না তো! গোয়েবলসরা আজও বেঁচে নেই তো! কেননা, পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের এক প্রণেতাই এই বিদ্যাকে সরকারি মিথ্যাভাষণ ছাড়া আর কিছু নয় বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। রাষ্ট্রেরই গোপন সমঝোতায় গবেষক, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিকরা নিদান দিচ্ছেন কিনা কে বলতে পারে? যার ওপর ভিত্তি করে বিরোধীরা নৃত্য করছে, আর সরকার পালটা পরিসংখ্যান দিচ্ছে। দু’পক্ষের এই সাপলুডো আবহমানকাল ধরেই চলছে। দেশের মানুষকে সরকার ও বিরোধী এই দুটো জার্সি পরিয়ে গাধার দৌড়ের প্রতিযোগিতা চলছে। আমরাও ছুটছি। একদল ‘আন্দোলনজীবী’ তো অন্যদল ‘প্রতিবিপ্লবজীবী’। করোনা নিয়েও সেই প্রতারণার খেলাই চলছে না তো! তা না হলে, টিকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সাফাই দিতে হচ্ছে কেন?
রবিবার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, আমি প্রত্যেককে বলছি, বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করুন। আমাদের বিজ্ঞানীদেরও বিশ্বাস করুন। দেশে প্রচুর মানুষ টিকা নিয়েছেন। টিকা নিয়ে যে গুজব ছড়াচ্ছে, তাতে কান দেবেন না। টিকাকরণ নিয়ে অগ্রগতির বিষয়ে বলেন, ২১ জুন দেশে ৮৬ লক্ষেরও বেশি মানুষকে বিনামূল্যে টিকা দিয়ে রেকর্ড তৈরি হয়েছে। একবছর আগে প্রশ্ন ছিল, টিকা কবে আসবে। আর আজ আমরা দেশে তৈরি টিকা বিনামূল্যে দিতে পারছি। এরপরই প্রধানমন্ত্রী তাঁর মায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমার বৃদ্ধা মা দু’টি টিকাই নিয়েছেন। আমিও নিয়েছি। যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তাঁদেরকে যা ইচ্ছে করতে দিন। দয়া করে ভয় ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। করোনা রুখতে টিকার বিকল্প নেই। টিকা না নেওয়া কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। টিকা না নিলে আপনি যে শুধু নিজের ক্ষতি করছেন তা-ই নয়, নিজের পরিবারকেও ঝুঁকির মুখে ফেলছেন।
মোদিকে আজ একথা বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, দেশ তাঁকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার নেপথ্য কারণ আরও গভীর। মানুষের অশিক্ষা ও অজ্ঞানতা। স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও দেশের মানুষকে রাষ্ট্র রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অন্তত লিখিতে পড়িতে’ শেখাতে পারেনি। সে কারণে আজও আমরা পোলিওর টিকার মতো কুসংস্কারের যুগে পড়ে রয়েছি, পক্ষান্তরে বলা ভালো ফেলে রাখা হয়েছে। সে কারণে উন্নত দেশগুলিতে টিকাকরণ প্রায় শেষ। কারণ, সরকার জানে, সেটা নাগরিক অধিকার। আমাদের দেশের মতো ভিক্ষার দান নয়। তাই নানা টিকার নানা দাম। কোথাও সুলভ, তো কোথাও দুর্লভ। ফেল কড়ি, নাও টিকা। প্রধানমন্ত্রীর মা তো দুটো টিকাই পেয়েছেন, কিন্তু দেশের কোটি কোটি নাগরিক যে প্রথম টিকাই পাননি, কবে পাবেন তাও জানেন না, তার কী হবে?
সুতরাং, আমরা সেই কবির ভাষায় ‘বঞ্চিত…’দের দলেই রয়ে গেছি। পাকিস্তানে হাফিজ সইদের বাড়ির সামনেের বিস্ফোরণের দায় কার? তা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারি, কিন্তু, বিশ্বাস করি, জম্মুতে ও পুলওয়ামায় হামলার পিছনে পাক হাত রয়েছে। সরকারও তাদের পোষা ডালকুত্তাদের মারফত রটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কাশ্মীরে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টায় এই নাশকতা। একই ছায়াযুদ্ধে আমরা যত সংখ্যক পাক সেনা মারার খবর ছাপি, একই দিনের পাক সংবাদে তত জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর খবর ছাপা হয়। সত্য তাহলে কী? কোন সরকার প্রতারক!
এভাবেই রাষ্ট্রীয় প্রতারণা চলছে বছরের পর বছর। চিটফান্ড, ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, শেয়ার বাজারে ধসের মতো প্রতারণার কাছে শিশুমাত্র। আমি বেঁচে আছি, এটাই রাষ্ট্রীয় ঔদার্য, সরকারি মাহাত্ম্য। গণতন্ত্রে এভাবেই মানবদরদি মুখ ও মুখোশের পরিবর্তন হয়। মূল কাঠামোর কোনও রূপান্তর ঘটে না। ঘটা সম্ভবও নয়।
কারণ, রাষ্ট্রকে আমরা নিরঙ্কুশ বিশ্বাস করি, থুড়ি বিশ্বাস করতে হয়। প্রতারিত হচ্ছি জেনেও রামরাজ্যকে ধন্য ধন্য করতে হয়। সে কারণেই ‘প্রতারিত’ সীতার অগ্নিপরীক্ষার সময় বিরোধী কণ্ঠ কেউ ছিল বলে জানা নেই। কেননা, রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি রামরাজ্যেও একই ছিল মনে হয়।