কলকাতা: সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া৷
গুগাবাবা-র গুপি বাঘের সামনে পড়ে ভয়ার্ত গলায় বলেছিল, ‘গান কই?’ করোনার সামনে সঙ্গীতশিল্পীদের অবস্থাও হয়েছে তেমন৷ তাঁদের প্রাণে গান থাকলেও বাইরে গান নেই৷ কারণ ‘দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা৷’ শিল্পীদের আজ সত্যিই দুঃসময়৷ করোনা বদলে দিচ্ছে গান শোনার চর্চা। বন্ধ গ্রামের মাচা থেকে শহরের কনসার্ট। রেকর্ডিং স্টুডিওতে সুর নেই, জমছে অন্ধকার। ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। ফুরিয়ে আসছে সঞ্চয়। বাংলা গান নিজেই তার ছন্দ হারিয়েছে। লকডাউনের জেরে এ বছরও মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলা গানের জগৎ।এমনটাই আশঙ্কা করছেন শিল্পীরা।
সঙ্গীতশিল্পী কৌশিকী চক্রবর্তী জানেন না ঘুরে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি কবে আসবে৷ তাঁর খেদ, “আমাদের অল্প সঞ্চয় থাকলেও এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে। অনলাইন কনসার্টে আনন্দ, অভিজ্ঞতা, চ্যালেজ্ঞ কোনওটাই নেই।” এখানেই থেমে থাকেননি কৌশিকী৷ বেশ রাগতস্বরেই বলেছেন, “সৃজনশীলতা, কালচার, কৃষ্টি ভারতবর্ষকে সংজ্ঞায়িত করে। সেই সংস্কৃতি যাঁরা বজায় রাখেন তাঁদের কথা সরকারের ভাবা উচিত। যেখানে মিছিল হতে পারে, সিরিয়ালের শুটিং হতে পারে, স্যুইগি, জোমাটোর পর রেস্টুরেন্ট খোলা হতে পারে, সেখানে অডিটোরিয়াম খুলে কম সংখ্যক লোক নিয়ে কনসার্টের কথা কেন ভাবা হচ্ছে না?’’
সামনের কয়েক মাস বিদেশে থাকার কথা ছিল সঙ্গীতশিল্পী মনোময় ভট্টাচার্যের। করোনার জেরে সব বাতিল। বললেন, ‘‘ধীরে ধীরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি প্রত্যেকেই। জীবনযাপনের অভ্যাস বদলে গিয়েছে। বিদেশে পাঁচ-ছ’টি অনুষ্ঠান বাতিল। আমরা সবাই খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। মানুষ এখনও সচেতন নয়। তাই এ বছরও খুব একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে বিনোদন কিন্তু বিলাসিতা। অনলাইন শো-এর মধ্যে দিন কাটছে।”
বরাবরই দলের কথা ভেবে এসেছেন সঙ্গীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র। তবে ৫৪ বছর বয়সে এসে তিনি নিজেই অনিশ্চয়তার জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাঁর কথায়, “এরপর আর ফিরে দাঁড়াতে পারব কি না, তা নিয়ে চিন্তিত। দলের অনেকেই ইতিমধ্যে কাজ হারিয়েছেন। সবাইকে আশ্বাস দিলেও মাঝে-মাঝেই নেগেটিভ হয়ে পড়ছি।’ এখন কিছু অনলাইন শো আর বাচ্চাদের গান শিখিয়ে তাঁর সময় কাটছে। তবে তিনি মনে করেন, ‘অনলাইনে গান করা আর পাথরের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে পার্থক্য নেই। অবশ্য অনেক কিছু ‘না’-এর মধ্যেও বলব, রেওয়াজ করা, মেডিটেশন করার মধ্যে নিজেকে রিফর্ম করার সুযোগ পেয়েছি।”
রূপঙ্করের মনেও দুঃখ আছে৷ মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘এ তুমি কেমন তুমি’ গাওয়ার যে আনন্দ তা তো বাড়িতে বসে হয় না৷ বললেন, “একমাত্র রাজনৈতিক মিটিং ছাড়া কোথাও লোকজনের জমায়েত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই কনসার্ট করে রোজগারের কোনও উপায় নেই। যন্ত্রশিল্পীদের পাশাপাশি গানের জগতের সঙ্গে যুক্ত লক্ষাধিক মানুষের অবস্থা খুব খারাপ। টেলিভিশন জগৎ কিছুটা হলেও বাঁচিয়েছে আমাকে। তবে অনলাইন কনসার্ট, ফেসবুক লাইভে এসে নিজের অস্তিত্বের জানান দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করি না।”
চ্যানেল থেকে গান রিলিজ করছেন অনুপম রায়। শেষে কি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আলো ফেলবে সুরের জগতে? অনুপম বললেন, “একেবারেই না। নতুনদের এই সময় এখান থেকে খুব একটা রোজগারের সম্ভাবনা নেই। আমার গানের পরিচিতি আছে। কিছু টাকা পেয়েছি। এই পর্যন্তই। বিশেষত ফোক মিউজিশিয়ন, যাঁরা লাইভ কনসার্টেই নির্ভরশীল তাঁদের অবস্থা খুব খারাপ। অনলাইনে গান গাওয়ায় দর্শকদের সঙ্গে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে গানের জগতে।কবে আবার বাংলা গানের জগৎ ঘুরে দাঁড়াবে তা এখনই বলা মুশকিল।”
করোনা আবহে গুরুদের পাশাপাশি শিষ্যদের অবস্থাটা ঠিক কীরকম?
২০১৫ সালের রিয়েল্যাটি শো-এ চ্যাম্পিয়ন সৌম্য চক্রবর্তী বললেন, “পরিস্থিতি অনুযায়ী শুধু শিল্পীরাই নন, সমাজের বৃহত্তর অংশই খাবি খাচ্ছে। দুটো বছর চেনাল একার লড়াই কাকে বলে। অনুষ্ঠান তো নেই, রেগুলারের সঙ্গীতময় কর্মমুখর জীবনটা কেমন যেন নিস্তেজ দেখছি। অনলাইন কনসার্ট শুনতে বেশ কর্পোরেট লাগলেও শিল্পীদের কাছে বড্ড তুচ্ছ। কারণ আমরা বেঁচেই থাকি হাজার হাজার করতালি, স্টেজ, লাইট, মানুষের ধুলো ওড়ানো নাচ, লেট নাইটে সেই অনুষ্ঠানের রেশ নিয়ে বাড়ি ফেরা। ডিজিটাল কনসার্টে সে-সব তো হয় না, পাশাপাশি সেই পরিমাণ উপার্জন হয়ও না। আমাদের ঘিরে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁরা ডিজিটালি অনুপস্থিত। আজ কমার্শিয়াল সমাজের সবকিছুই প্রায় খোলা।মরলাম কারা? আমরা! আস্তে আস্তে এরপর শোগুলো চালু হলে আমরা ভালো থাকবো অন্তত মানসিক ভাবে। এই পরিস্থিতিটার শুধু উন্নতি হোক। এটুকুই চাই।”
আর এক চ্যাম্পিয়ন জিমূত রায়ের মতে, “এখন মানুষের আনন্দ করার প্রবৃত্তিটা কিছুটা হলেও কম। শুধু করোনা আবহ বলেই নয়, এই বিশ্বায়নের যুগে সবাই ডিজিটালকেন্দ্রিক। তাই সবাই খুব বেশি সিলেক্টিভ। যার ভিডিও ভালো লাগবে, তারটা মানুষ দেখবে। যার ভালো লাগবে না, স্ক্রল ডাউন করে এগিয়ে যাবে।কাল কালের নিয়মেই এগোবে। সুতরাং আমার কাজ গান গাওয়া। এটা থেমে থাকবে না।”
চ্যাম্পিয়ন অঙ্কিতা ভট্টাচার্য্য অবশ্য ভরসা রাখছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। এই বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অঙ্কিতা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালোই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। “আই গিরি নন্দিনী” গানটি ইতিমধ্যেই ৩ মিলিয়ন দর্শক দেখেছেন। গান বরাবরই প্রথম পর্যায়ে ছিল, থাকবে। রেওয়াজের পাশাপাশি ইউটিউবে গান বানাচ্ছি। উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতিও চলছে। পর্দায় মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে গেলেও সেটা পূরণ করছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। তাই একেবারেই আশার আলো দেখছি না এমনটা নয়।” বললেন অঙ্কিতা৷
শিষ্যদের কথা ভেবে যথেষ্ট আশঙ্কায় কৌশিকী-লোপামুদ্রা-মনোময়-রূপঙ্কর।তাঁরা মনে করছেন, ‘‘বিগত ১৯ মাস ধরে বন্ধ সবকিছুই। তাই এই দুই বছরে যাদের আরও পরিচিত হয়ে ওঠার কথা ছিল তাদের সবাইকেই কঠিন লড়াই লড়তে হবে৷”
তবে গৃহবন্দি মানুষকে একদিন ফিরতেই হবে গানের কাছে। সবাই মিলে আবার গান গেয়ে উঠবেন৷ সে বড় প্রাণের আরাম!
আরও পড়ুন: চাঁদের ‘খামখেয়ালি চলন’, বিশ্বজুড়ে প্রবল বন্যার আশঙ্কা নাসার