মালবাজার: ডুয়ার্সের গরুমারা জঙ্গলের বুক চিরে চলে গিয়েছে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক। আর এই সড়ককে নিয়েই উঠে এসেছে একাধিক ভৌতিক গল্প। এমনিতেই দিনের আলোতে এই রাস্তার পরিবেশটাই গা ছমছমে। লাটাগুড়ির রেল গেট পেরিয়ে যেতেই পুরো রাস্তাটাই নিস্তব্ধ শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের অন্যতম ডেস্টিনেশন এই এলাকা। তবে এই ভালোলাগার মধ্যেও রয়েছে এক ভৌতিক আতঙ্ক। বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা যেটা কিনা ভাবিয়ে তুলেছে সেই এলাকাবাসীকে।
আরও পড়ুন: নজরে নোরা
সম্প্রতি, গত রবিবার সন্ধ্যেবেলায় লাটাগুড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিলেন জলপাইগুড়ির শহরের এক পরিবার। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা হঠাৎই তাঁরা দেখতে পান ওই রাস্তায় সাদা শাড়ি পড়া খোলা চুলে এক মহিলা গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেখামাত্রই ভয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয় ওই পরিবার। তারপর হঠাৎই সাদা শাড়ি পরা সেই মহিলা গাড়ির বনেটের ওপরে উঠে বসে। মুখ দিয়ে বিকট শব্দ করতে থাকে। এই দৃশ্য দেখার পর ভয় পেয়ে যায় সেই পরিবারটি। পরে রাস্তায় অন্যান্য গাড়ি এসে পড়ায় সকলে মিলে ওই মহিলাকে ধরে মেটেলি থানার হাতে তুলে দেয়। ওই মহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন নাকি এই ঘটনার পেছনে রয়েছে অন্য কোনও উদ্দেশ্য, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। অপরদিকে, এই ঘটনার সময় আরও বেশ কয়েকজনকে জঙ্গলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। আর এখান থেকেই প্রশ্ন উঠেছে ভূতের ভয় ছড়িয়ে কোনও দুষ্কৃতী দল এখানে কোনও দুষ্কর্ম করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। যা এই মহিলা ধরা পড়ে যাওয়ায় ভেস্তে গেল।
এই ঘটনাটি ছাড়াও এই এলাকা নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে একাধিক অলৌকিক ঘটনা মুখে মুখে শোনা যায়। এদের মধ্যে অনেকেই আবার ভূতের দেখা পেয়েছেন বলেও দাবি করেছেন। তবে সেই সমস্ত ঘটনা সত্যি নাকি শুধুই মিথ তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
এলাকাবাসীর মুখে শোনা যায়, লাটাগুড়ি মহাকাল মন্দিরের কাছে এক মহিলাকে দেখা যেত। যিনি সন্ধ্যেবেলায় মাঝেমধ্যেই অনেক বাইক আরোহীকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করাতেন। সেইসব বাইক আরোহীদের কাছে সেই মহিলা অনুরোধ করতেন তাঁকে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তারপর বাইকে সেই মহিলাকে চাপিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই নাকি অদৃশ্য হয়ে যেত সেই মহিলা। তবে এইসব লোক মুখে শোনা ঘটনার সম্মুখীন হওয়া ব্যক্তির হদিস এখনও মেলেনি।
আরও পড়ুন: মেঘে মেঘে রসনা তৃপ্তি
এই ভয় বাসা বেঁধেছিল বিন্নাগুরির বাসিন্দা অর্ঘ্য আচার্যের মনেও। বছর দুয়েক আগের ঘটনা মৌলানি থেকে লাটাগুড়ি হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল তাই বাড়ি ফেরার তাড়া ছিলও তাঁর। মহাকাল মন্দিরের কিছুটা আগে অর্ঘ্য বাবুর স্কুটির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টার পরেও তিনি সেই স্কুটি স্টার্ট করতে পারছিলেন না। অবশেষে কোনও উপায় না দেখে কোনরকমে সেখান থেকে স্কুটি ঠেলতে ঠেলতে রওনা হন তিনি। তিনি মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলেন এসবের পেছনে রয়েছে কোন অশরীরী আত্মার কারসাজি। প্রায় দু কিলোমিটার এভাবে এগোতেই স্কুটি ফের স্টার্ট হয়ে যায়। তবে এই ঘটনার পেছনে আদৌ কোনও অলৌকিক যোগ রয়েছে নাকি তা কেবলই যান্ত্রিক গোলযোগ ছিল সেই বিষয়টি কিন্তু আর যাচাই করেননি তিনি।
অন্যদিকে, এই জঙ্গলের রাস্তায় অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যাটাও কম নয়। অনেকরই ধারণা অপঘাতে মৃত্যুর ফলে এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় সাধারণ মানুষকে।
তবে যুক্তিবাদীদের মতে, এই সমস্ত ভূতের কাহিনীর আড়ালে রয়েছে বড় কোনও অপরাধের ষড়যন্ত্র। ভূতের গল্পকে সামনে রেখে এই রাস্তায় হতে পারে একাধিক অপরাধমূলক কাজ। কাজেই ভূতকে মাথা থেকে সরিয়ে মানুষকে সচেতন থাকার বার্তা দিয়েছেন যুক্তিবাদীরা।
পর্যটন ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন, “কাজের সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই সকাল, বিকেল কিংবা রাতে এই রাস্তা দিয়েই আমাদের যাতায়াত করতে হয়। আমাদের চোখে আজ পর্যন্ত কোনও ভূতের দেখা মেলেনি। মানুষের মুখে মুখে প্রচার হওয়া কিছু গল্প থেকেই এই ভূতের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গলের রাস্তা এমনিতেই গা ছমছমে, সেখানে বন্য জন্তু জানোয়ারের ভয় আছে বৈকি তবে ভূতের কোন ভয় নেই।”
লোকের মুখে ফেরা পুরনো কিছু গল্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ঘটে যাওয়া এমন কিছু কাকতালীয় ঘটনার মিশেলে লাটাগুড়ি এলাকায় ভূতের আতঙ্ক অন্যতম কারণ কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন যুক্তিবাদীদের কাছে? যদিও এই সমস্ত ঘটনাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ এলাকার পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা। তাঁরা এইসব গুজবে কান না দিয়ে লাটাগুড়ি, গরুমারা ও মূর্তি এলাকার সবুজকে উপভোগ করার বার্তা দিয়েছেন।