লুঙ্গি পরলে মুসলমান। কে শিখিয়েছেন? বিদ্যাসাগর, রামমোহন তো নয়, আমাদের দেশের চৌকিদার নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। কাজেই পোশাক দেখে মানুষ চেনো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে বিজেপিতে। এবং এই প্রথম নয়, কৃষি বিল নাকচ করার দাবিতে কৃষক আন্দোলনে শিখদের অংশগ্রহণ দেখেই বলা হয়েছিল খালিস্তানি। কাঁধে ব্যাগ আর হালকা দাড়ি, চোখে গোল চশমা দেখলেই অমিত শাহজির মনে হয় এঁরা টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের সদস্য, পারলে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়টাই তুলে দেন। ওদিকে যোগীজির রাজ্যে তো স্লোগানই হল ইউ পি মে রহনা হোগা, যোগী যোগী কহনা হোগা, না হলে বুলডোজার তো আছেই। নন্দীগ্রামে আমাদের টাচ মি নট খোকাবাবু সাফ জানিয়েই দিয়েছেন, ওই ৩০ শতাংশের ভোট আমাদের দরকার নেই। কৈলাস বিজয়বর্গীয় আবার চিঁড়ে খেতে দেখলেই বুঝে যান যে ইহারা বাংলাদেশের নাগরিক, না হলে চিঁড়ে খাচ্ছে কেন? ধর্ষণ করেছে তো কী আছে? নামের শেষে পদবি দেখে বিজেপি বিধায়ক বুঝে যান ধর্ষকরা আসলে সংস্কারী ব্রাহ্মণ, আর ব্রাহ্মণদের অমন অধিকার তো দেওয়াই আছে। বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়াতে সারদা মাকে নিয়ে মিম হয়, বলা হয় আমি শাহজাহানের মা, উত্তমেরও মা। সারদা মা বেঁচে থাকলে ১০০ শতাংশ একমত হতেন। ডাকাতকে যিনি নিজের হাতে খাইয়ে দেন, যাঁর স্বামী তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছিলেন সেই সারদা মা যে শাহজাহানের মা, উত্তমেরও মা, তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়, বিজেপির আছে। সেই বিজেপির আগে বড়লোকেদের দর্জি আপাতত রাজনীতিবিদ পাগড়ি দেখেই এক পুলিশ অফিসারকে খালিস্তানি বলেছেন। এতে অবাক হওয়ার কী আছে? তিনি তো আবার পোশাক বিশেষজ্ঞ, তাই জানেন খালিস্তানিরা কী কী পরে থাকে। এমনও হতেই পারে যে ওঁর সঙ্গে খালিস্তানিদের ভারি ভালো যোগাযোগ আছে, উনি জানেন খালিস্তানিরা কেমন পাগড়ি পরেন। কেবল কি উনি, ওই শিখ পুলিশ অফিসার জানাচ্ছেন, আমাদের টাচ মি নট খোকাবাবুও জানেন পাগড়ি পরলেই সে খালিস্তানি। এখন গাব গাছে তো হিমসাগর আম ধরবে না, সে আমরা জানি। কিন্তু মানুষের কাছে তো এই খবর পৌঁছতেই হবে, তাই আমাদের বিষয় আজকে পাগড়ি পরলেই খালিস্তানি।
জেনেটিক ডিজিজ বলে একটা কথা আছে। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের পণ্ডিতরা এই জেনেটিকস নিয়ে গভীর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আর প্রতিটা গবেষণার শেষেই ওই জেনেটিকস-এর এক বিরাট এবং সর্বগ্রাসী প্রভাবের কথা জানা যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে, ওই গাব গাছে হিমসাগর না ধরার পিছনে রয়েছে ওই জেনেটিকস। সেই তত্ত্ব মেনেই বিজেপির জেনেটিকস বিচার করতে গেলে খুব বেশি তো পিছোতে হবে না। আমাদের প্রত্যেকের মতোই ওঁদেরও বিবর্তন তো শেষ পর্যন্ত বানর থেকেই।
আরও পড়ুন: Aajke | আমি নিজেই আমার সওয়াল করতে চাই: কৌস্তুভ রায়
কিন্তু বিবর্তনের যে ধারা তা কোথাও কোথাও ভেঙেছে, কোথাও রুদ্ধ হয়ে গেছে, কোথাও অন্য পথে বাঁক নিয়েছে এমনও তো হয়েছিল। কারও কারও মধ্যে বানরসুলভ আচরণ বেশি দেখা যায়, কারও কম, এসব ওই জেনেটিকস-এর কামাল। তো সে যাই হোক সেই জেনেটিকসকে তো ওঁরা মানে ওই আরএসএস-বিজেপি অস্বীকার করে। ওঁদের তত্ত্ব হল ব্রহ্মা, সৃষ্টিকর্তার মাথা থেকে ব্রাহ্মণ, বুক থেকে ক্ষত্রিয়, জানু থেকে বৈশ্য আর পা থেকে শূদ্রদের জন্ম। এটাই ওনাদের যাবতীয় বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি। এ বিশ্বাসের পিছনে কোনও যুক্তি আছে? নেই, থাকাটা সম্ভবও নয়, কেবল আস্থার কথা। রামের জন্মভূমি ওঁরা খুঁজে পেয়েছেন শুধু তাই নয়, এক ঐতিহাসিক মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির তৈরিও হয়েছে। কিন্তু একজনও এই প্রশ্ন করেননি যে রামচরিত মানসের রচয়িতা তুলসীদাসজি একবারের জন্যও অযোধ্যার ওই জায়গার কথা বলেননি, সেখানে আসেননি। তিনি তো ঐতিহাসিক মানুষ ছিলেন, তাঁকে সংস্কৃত ছেড়ে চলতি ভাষাতে রামকাহিনি লেখার দায়ে পুড়িয়ে মারতে উদ্যত ব্রাহ্মণদের আটকেছিল সম্রাটের সৈন্যরা। রামচরিত মানস পুঁথি পোড়াতে দেননি কারা? মসজিদের ইমাম, তাঁর সাগরেদরা। তো তিনি সেই সম্রাটকে তো বলতেই পারতেন, হুজুর রামলালার জন্মস্থানটা ছেড়ে দিন। উনি জানতেন কল্পকাহিনি আর পুরাণ চরিত্রের জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক করার কোনও মানেই নেই। কিন্তু বিজেপি তো যুক্তি, তর্ক, তথ্যতে বিশ্বাসই করে না, করে না বলেই ওঁদের এক মসজিদ নয়, যাবতীয় মসজিদ ভেঙেই নিজেদের জয়স্তম্ভ খাড়া করার ইচ্ছে। আসলে হঠাৎ করে কোনও এক বাঁকে অন্য মানুষদের তুলনায় ওঁদের ওই জিনে যুক্তি, তর্ক, বোধ, জানার ইচ্ছে এসব হারিয়েছে, এবং তারপর ঘটি হারিয়েছে। বেড়াল কুকুর, মনুষ্যেতর প্রাণীদের যেরকম কন্ডিশনিং থাকে, খানিকটা সেই রকম। লাল রং জ্বললে খাবার খাওয়া বন্ধ করতে হবে, সবুজ রং জ্বললে খেতে হবে, কুকুর, বেড়াল, পাখিদের এরকম ট্রেনিং দেওয়া হয়। তারা যুক্তি বোঝে না, তথ্য বোঝে না, লাল হলে খাওয়া বন্ধ করে, সবুজ হলে খাবার খায়। কিছু খালিস্তানিকে মাথায় পাগড়িওলা দেখেছেন, তাই ভগৎ সিংও খালিস্তানি, এরকম এক কন্ডিশনিংয়ের শিকার আমাদের টাচ মি নট দাদা আর পোশাক বিশেষজ্ঞ। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, লুঙ্গি পরলেই প্রধানমন্ত্রী বুঝে যান সামনের লোকগুলো মুসলমান, পাগড়ি মাথায় থাকলেই আমাদের রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বা বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল নয় পল বুঝে যান সে খালিস্তানি, একে মূর্খতা বলবেন না শয়তানি? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
কুকুর বেড়াল হাতি বা পাখিদের ওই কন্ডিশনিং বিহেভিয়ারের থেকে এই শুভেন্দু অধিকারী বা অগ্নিমিত্রা পলেদের ব্যবহারের তফাতটা কোথায়? তফাত আছে, বিরাট তফাত আছে। কুকুর বেড়াল হাতি বা পাখি ষড়যন্ত্র করতে জানে না, বিষ ছড়িয়ে সমাজটাকে বিষাক্ত করতে জানে না, কিছু কথা বার বার বলে মানুষে মানুষে বিভেদের কুমন্ত্রণা গুঁজে দিতে জানে না। এঁরা জানেন। তাই একজন পাগড়ি পরা পুলিশ অফিসারকে খালিস্তানি বলে আসলে সমাজের দেশের মানুষদের মধ্যেই এক বিভেদের দেওয়াল খাড়া করার চেষ্টা করে চলেছেন এই বিজেপির বড় থেকে মেজো সেজো ছোট মায় পুঁচকে নেতানেত্রীরা।