মহম্মদ ঘোরি বার কয়েক ভারত আক্রমণ করেছিলেন৷ হেরে পালিয়ে গিয়েছিলেন৷ তরাই-এর যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহান তাঁকে হারিয়েছিলেন৷ তিনি আবার পালিয়েছিলেন৷ কিন্তু ধূর্ত, লোভী, লুঠেরা মহম্মদ ঘোরি আবার ফিরেছিলেন নতুন শক্তি সঞ্চয় করে, নতুনতর অস্ত্র নিয়ে৷ জিতেছিলেন৷ পৃথ্বিরাজ চৌহান হেরেছিলেন। এরকম ইতিহাসে বার বার হয়েছে, দেশে দেশে হয়েছে। বৃহস্পতিবার মহারাষ্ট্রে হল। নির্বাচনের পরেই এনসিপি ভাঙিয়ে ভোর রাতে রাজ্যপালকে জাগিয়ে, শপথ নিয়ে সরকার তৈরি করেও টেঁকাতে পারেনি বিজেপি৷ তারপরে আরও একবার, কিছু শিবসেনা, কিছু কংগ্রেস ভাঙিয়ে সরকার তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে, সফল হয়নি। এবার আটঘাট বেঁধেই শিবসেনা ভাঙিয়ে বকলমে সরকার তৈরি করল বিজেপি৷ শুরুর দিকে বিজেপির তরফে কোনও কথাই বলা হয়নি৷ ভাবখানা হল, ও শিবসেনার ব্যাপার, আমরা কিচ্ছুটি জানি না।
তারপর গুজরাটের রিসর্ট৷ তো গুজরাট কেন? সবাই জানে কেন গুজরাট। মুশকিল হল মুম্বই বড্ড কাছে, যদি প্ল্যান ভেস্তে যায়? তাই রিসর্ট পলিটিক্সে টুইস্ট৷ চার্টার্ড ফ্লাইটে করে ঘোড়া, গাধাদের, থুড়ি বিধায়কদের নিয়ে যাওয়া হল অসম৷ আরও এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে। ছোটা মোটা ভাই এর সঙ্গে মিটিং, নানান আলোচনা চলছে, সব্বাই জানে কী হচ্ছে। বিজেপির বক্তব্য ওসব শিবসেনার ব্যাপার। এরপর আদালত, ১৬ জন বিধায়কের পদ খারিজ করার আবেদন, স্পিকারের কাছে। একই ঘটনা ঘটেছিল কর্ণাটকে, ঘটেছিল মধ্যপ্রদেশে, কেবল সেখানে বিধায়ক পদ খারিজ করার আবেদন ছিল বিজেপির তরফে৷ আদালত সায় দিয়েছিল৷ এবার মহামান্য আদালত, যিনি কখনই ভুল রায় দিতে পারেন না, যিনি কখনই কারোর দ্বারা প্রভাবিত হন না, তিনি মানে মহামান্য আদালত আবেদন খারিজ করে দিলেন৷ অসম থেকে বিধায়কদের মহারাষ্ট্র আনার আগে গোয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ আদালতের রায় বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই উল্লাস, উল্লাস।
এবার মাঠে বিজেপি৷ প্রকাশ্যে বিজেপি৷ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে একনাথ শিণ্ডে। অন্য আলোচনায় যাবার আগে এই বিষয়েই আরও দুটো কথা৷ প্রথম কথা হল, শিবসেনার ভাঙন। শিবসেনা এক পারিবারিক দল, বালাসাহেব ঠাকরে কোনওদিন কোনও নির্বাচনে দাঁড়াননি৷ কোনও নির্বাচনে জেতেননি৷ কিন্তু মহারাষ্ট্র শাসন করেছেন মাতোশ্রী থেকে। পারিবারিক দল, তাই প্রশ্ন ছিল, উদ্ধব ঠাকরে না রাজ ঠাকরে? বহু আগে ছগন ভুজবল, সুরেশ প্রভু, নারায়ণ রানে শিবসেনা ছেড়েছেন, কেন? কারণ, বুঝেছেন শিবসেনাতে থাকলে, দুই কি তিন, কি চার নম্বরেই থাকতে হবে৷ এক নম্বর তো ঠাকরেদের৷ রাজ ঠাকরে দেখলেন, বালাসাহেব নিজের ছেলেকেই বাছলেন, ভাইপোকে নয়, তিনিও বেরিয়ে গিয়েছেন। পারিবারিক দলে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক৷ জমিতে কাজ করা নেতা হঠাৎ দেখলেন, তাঁর ওঠার রাস্তা বন্ধ। একনাথ শিণ্ডে সেটাই দেখেছিলেন৷ ওসব হিন্দুত্ব ইত্যাদি কিছুই নয়, কারণ এই একনাথ শিণ্ডেই মহারাষ্ট্র আগাড়ি সরকার যাতে তৈরি হয়, তার জন্য প্রাণপাত করেছেন৷ প্রথমবার ভাঙার চেষ্টার সময় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন৷ এখন নিজেই দাঁড়ানোর ইচ্ছের পাশে পেয়ে গেলেন বিজেপিকে। কাজেই দুটো ঘটনা ঘটবে, প্রথমটা হল শিবসেনার দখল নেবেন শিণ্ডে এবং তা হবে চরম হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা৷ দুই হল, শিবসেনার দখল নিতে না পারলে বিজেপিতেই ভিড়ে যাওয়া৷ দুটোর বাইরের সম্ভাবনা রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়া, যেটা এত তাড়াতাড়ি হবে না।
সমস্যা আরও গভীরে৷ শিবসেনা ছিল মূলত ‘মারাঠা মানুস’ এর দল৷ হিন্দুত্ব ছিল দ্বিতীয় বিষয়৷ শিবাজী মহারাজ, মারাঠা গৌরবই ছিল শিবসেনার ভিত্তি৷ তা যদি কেবল হিন্দুত্বের ওপরেই ঝুঁকে পড়ে, তাহলে বিজেপি কী দোষ করল? বালাসাহেব এই ব্যালেন্সটা বজায় রেখেছিলেন৷ উদ্ধব ঠাকরে এই কাজে অসফল৷ তিনি কেবল ভালো প্রশাসকই হতে চেয়েছেন৷ ক্ষমতা রাজ ঠাকরের হাতে থাকলে, ছবিটা সম্ভবত আলাদা হত। যাই হোক, বিজেপি প্রকাশ্যেই তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল।
একই ঘটনা এর আগে তাঁরা ঘটিয়েছেন গোয়াতে, মধ্যপ্রদেশে, কর্ণাটকে৷ এবার মহারাষ্ট্রে এবং চরম নির্লজ্জভাবে, কে কী মনে করল, সংবিধান কী বলছে, গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়ম বা ধারণা, ওসব নিয়ে বিজেপির বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই৷ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বিজেপির রাগ আজকের নয়৷ এই সংবিধান রচনার প্রথম দিন থেকেই, তাই কালাপাহাড়ের মতো একের পর এক আক্রমণ নেমে আসছে যাবতীয় গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক কাঠামোগুলোর ওপর। এর সঙ্গে বিকিয়ে যাওয়া চতুর্থ স্তম্ভ৷ এত নির্লজ্জ তাদের আচরণ যে নিজেকে সাংবাদিক বলতেও, আজকাল লজ্জা হয়৷ আরে ভাই কভি তো সচ বোলও? মানে মিথ্যে বলবে তো জানিই, একবার, মাঝেমধ্যে একবার অন্তত সত্যিটা তো বলো। চ্যানেলে চ্যানেলে এক অটো ড্রাইভার কিভাবে এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হল, তার বিবরণ দিয়েই যাচ্ছে।
এক অটো ড্রাইভার খুনি অটো শঙ্করও তো হতে পারে৷ এক চাওয়ালা হয়ে উঠতেই পারে একজন পকেটমার, তো? একজনও প্রশ্ন করছেন না, লেনদেন কত হল? কে জোগালো রিসর্ট, চার্টার্ড প্লেনের খরচ? না কেউ জিজ্ঞেস করছে না। কেন তিস্তা শীতলবাদকে গ্রেফতার করা হল? সে প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন কী? না তিস্তা শীতলবাদের বেঙ্গালুরুতে অত্ত বড় বাংলো কোথা থেকে এল? তিস্তা শীতলবাদের দাদু, ভারতবর্ষের অন্যতম ব্যারিস্টার ছিলেন৷ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের, বিচারবিভাগীয় কমিটির সদস্য ছিলেন৷ যাঁর প্রশ্ন এবং অবজার্ভেশনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মাইকেল ও ডয়ার৷ তিনি র্যাডক্লিফ কমিটির সদস্য ছিলেন৷ তিস্তার বাবাও ছিলেন ব্যারিস্টার এবং এক নাম করা বিচারক৷ তিস্তা তাঁদের সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ৷ কেবল সম্পত্তি নয়, ক্ষমতার সামনে প্রশ্ন করার, মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানোর শিক্ষাও তিনি বংশানুক্রমেই পেয়েছেন৷ চতুর্থ স্তম্ভ প্রশ্ন করছে সেই তিস্তার বাংলো নিয়ে৷ কয়েক রাতে যে কোটি কোটি টাকা খরচ হল, কোটি কোটি টাকার হাতবদলে ফেরবদল হল আনুগত্য, তা নিয়ে চতুর্থ স্তম্ভ চুপ করে বসে আছে। এবং এই গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক কাঠামোর ভেঙে পড়া দেখে ছাগলের তৃতীয় সন্তানদের কী আনন্দ, তারা হাত তুলে নাচছে।
এ বাংলায় সেই আনন্দ দেখা গেল, কাঁথির খোকাবাবুর চোখে মুখে, তিনি বললেন, এই মহারাষ্ট্রের হাওয়া ঝাড়খন্ড হয়ে ঢুকবে এই বাংলায়৷ এখানেও মানুষ যাই রায় দিক, মানুষ যার পক্ষেই থাকুক, সরকার হবে বিজেপির, তারপর? স্বাভাবিক তিনি আর কিছু বলেননি৷ বলার দরকার নেই, এ খোয়াবের, এই স্বপ্নের দ্বিতীয় অংশটাও আমরা জানি, গভর্নর ধনখড় খোকাবাবুকে শপথ গ্রহণ করাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর শপথ, তারপর মন্ত্রিসভা বন্টন, আগে পেছনে ব্ল্যাক ক্যাট, খোকাবাবু যায়, লালজুতো পায়। স্বপ্নের পোলাওতে কম ঘি দিতে নেই, বেশি করেই ঢালুন, সেই স্বপ্নে তৃণমূল তো নেইই, দিলীপ ঘোষও নেই, লকেট চট্টোপাধ্যায়ও নেই। কি আনন্দ। সবই তো হল, কিন্তু হবেটা কি ভাবে? রোজই তো তারা খসে যায়, অর্জুনও চলে গেছে, শিলিগুড়ি মহকুমা ভোট, সেখানেও হার, দার্জিলিং? সেখানেও। দক্ষিণে চারটের চারটেতেই জামানত জব্দ, উলটে বামেরা সামান্য হলেও ফিরে পাচ্ছে জমি, সেটা হতে থাকলে খোকাবাবুর আগামীবার বিধায়ক হওয়াও কঠিন, কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই, তিনি স্বপ্ন দেখছেন, তৃণমূল ভেঙে বাংলায় বিজেপির সরকার তৈরি হবে। তো আপাতত দুটো সাজেশন রইল ওনার জন্য, প্রথমটা হল, মন দিয়ে সংবিধানটা পড়ুন৷ ওই সংবিধান, যা রচনার জন্য মাতঙ্গিনী হাজরা থেকে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, সূর্য সেন থেকে ভগৎ সিং প্রাণ দিয়েছিলেন, যে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল এই বিজেপির উত্তরসূরি সাভারকার গোলওয়ালকরের দল, যারা খুন করেছিল জাতির জনককে, হ্যাঁ সেই সংবিধান পড়ুন, গণতন্ত্রের সাধারণ ধারণাটা ওখানেই পেয়ে যাবেন৷ বুঝতে পারবেন, আপনি যা চাইছেন, তা সত্যি করে হলেও, হবে অগণতান্ত্রিক। কিন্তু সমস্যা হল, এত পড়ার ধৈর্য বা শিক্ষা কোনওটাই কি ওনার আছে? দ্বিতীয় সাজেশনটা বরং সোজা, খিদিরপুরে চলে যান, হ্যাঁ এখনও ভালো মাংসের দোকান ওখানেই৷ গোপাল পাঁঠার দোকান আজকাল খোলে না, তো খিদিরপুরেই যান, হাজির দোকানে, বলবেন, পেছনের রাং থেকে ৫০০ টাকার চর্বি ছাড়া মাংস দিতে, তারপর পাড়ার বাজার থেকে বোঁটায় আঠা লেগে আছে এমন পেঁপে আর চন্দ্রমুখি আলু চাই, দু চামচ সাদা তেল, খুব কম আদা রসুন, পেঁয়াজ আর সামান্য জিরে, ধনে গুঁড়ো দেবেন, গুঁড়ো লংকা কভি নেহিঁ, একটু গোলমরিচ আর স্বাদ অনুসারে নুন দিয়ে প্রেসার কুকারে দুটো সিটি, ব্যস। এক থালা ভাত দিয়ে খান, পেটগরম কমবে, আর সেটা কমলেই আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখা বন্ধ হবে, শরীরও ভালো থাকবে। আগাম শুভেচ্ছা, ও হ্যাঁ একটা কথা জানিয়ে রাখি, খোকাবাবু দাদা, রাঁচিতে, মানে ঝাড়খন্ডে কিন্তু এখনও বিজেপির রাজত্ব নেই, ওখানে ঝাড়খন্ড পার্টি, হেমন্ত সোরেন, কাজেই রাঁচিতে যাবার কথা, মাথাতেও আনবেন না।