নাৎসি ও ফ্যাসিবাদের নির্যাতন নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়। গগনচুম্বী জাত্যাভিমান ও অন্য জাতির প্রতি অপরিসীম ঘৃণা হিটলার ও মুসোলিনিকে দানবসদৃশ করে রেখেছে। কিন্তু তার থেকেও সুপ্ত অথচ ভয়ংকর ছিল, দু’জনের প্রচারযন্ত্র ও প্রচার নিয়ন্ত্রণ। হিটলার ও মুসোলিনির আত্মপ্রচার তাঁদের জীবদ্দশাতে দু’জনকে ‘মিথে’ পরিণত করেছিল। মুসোলিনি যখন বিশ্বনেতাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে চলেছেন, তখনও ইতালির সংবাদ মাধ্যমকে সেই খবর ছেঁটে ছাপতে হয়েছে। এতক্ষণে নিশ্চই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, এখানে কাদের কথা বলতে চাওয়া হচ্ছে। ফিল গুড থেকে সবকা বিকাশ পর্যন্ত যে সরষে-শুকনো লঙ্কা পোড়া দেশবাসীর নাসারন্ধ্রে ঢুকেছে, তাতে অধিকারের ভূত জনতার মাথা ছেড়ে পালিয়েছে। ক্রমাগত ফেলের বিশ্বরেকর্ডেও আমরা শুনছি, আমরা এগোচ্ছি। যদিও তথ্য বলছে, জনস্বাস্থ্য থেকে সর্বজনীন শিক্ষা, শিশু অপুষ্টি দূরীকরণ বা বেকারত্ব বা— এইসব গুরুত্বপূর্ণ সূচকে পিছিয়ে পড়ছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। কার কাছে পিছোচ্ছে? শুনলে হাসি পাবে, ক্লাসে বেশি নম্বর পেয়ে এগিয়ে রয়েছে— বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপালের মতো দেশও। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল’ বা স্থায়ী উন্নতির সূচকে আগের তুলনায় দু’ধাপ নীচে নেমে এল ভারত।
বিষয়টি আসলে কী? ২০১৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল’ নামে একটি পরিকল্পনা হাতে নেয়। যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে শান্তি-সমৃদ্ধির ১৭টি বিষয়কে চিহ্নিত করে। তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দারিদ্র দূরীকরণ, দ্বিতীয়টি খাদ্যসুরক্ষা, তৃতীয়— সুস্বাস্থ্য, চতুর্থ—উন্নতমানের শিক্ষা, পঞ্চম— লিঙ্গবৈষম্য রোধ। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও পঞ্চম বিষয়ে খারাপ ফল করায় ভারতের স্থান দু’ধাপ নীচে নেমে গেছে।
বয়োঃজ্যেষ্ঠদের মনে আছে নিশ্চই এক সময় ইন্দিরা গান্ধী গরিবি হটাওয়ের ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর এই স্লোগানকে ঘিরে দীর্ঘ বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। বিরোধীরা এটাকে গরিব হটাও বলেও কটাক্ষ করেছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দেশের দারিদ্র দূরীকরণে কম কুস্তি চলেনি। দারিদ্রের যমজ ভাই হল অপুষ্টি। ফলে স্বভাবতই ভারতে শিশু অপুষ্টি শরীরের রোমের মতোই গেঁথে আছে। দারিদ্রের জন্য খাদ্যসুরক্ষার অভাব, নাকি খাদ্যসুরক্ষার অভাবে দারিদ্র! এ নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বিতর্ক জুড়তেই পারেন। মূল বিষয়টি হল স্বাধীনতার প্রায় ৭৫ বছর পরেও আমরা প্রতিটি মুখে পেটভরা ভাত তুলে দিতে পারিনি। আমরা চীন ও পাকিস্তান মিলিয়ে বেশ কয়েকটা সরকারি যুদ্ধ ও ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে গেছি। পরমাণু বোমা বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছি। মহাকাশে পদধূলি রেখেছি। আর আরবে আনপড়, অদক্ষ মজুর সরবরাহ করে, সমানুপাতিকভাবে ইউরোপ-আমেরিকায় আপাত শিক্ষিত-দক্ষ চাকর পাঠিয়ে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছি। আসলে কেউ গরিব মানুষের কথা ভাবেনি। তাই ধান-গম-যবের দেশেও মানুষকে অভুক্ত থাকতে হয়।
আর লিঙ্গ বৈষম্য? সতীদাহ-বাল্যবিবাহের দেশে মেয়েরা যে অসূর্যম্পশ্যা থাকবে সে আর এমননকী? যেখানে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশায় পাহারাদার হয় শিবসেনা, বজরং, এবিভিপি সেখানে কী আশা করা যায়! যে দেশে কন্যাসন্তানের জন্ম দিলে খুন করা হয়। মেয়েদের জামাকাপড়ের মাপ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীরাও বিবৃতি দেন। মেয়ের বিয়ে দিতে বাপকে সর্বস্বান্ত হতে হয়, সেখানে আর কত সিঁড়ি উপরে ওঠা যায়?
এসব নিয়ে রাজনৈতিক লড়াই, অর্থনীতির কচকচি, সামাজিক তত্ত্বকথা চলতেই থাকবে। শুধু গলায় কাঁটার মতো বিঁধছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপালেরও পিছনে আমরা! ওরা উন্নতি করেছে তাতে ঈর্ষা না করাই উচিত। কিন্তু, ভারতের আত্মগরিমার প্রচারের কী হল? আসলে ফানুসে উড়তে ভালোই লাগে, হোক না ভিতরে যতই হাওয়া ভরা থাক। তবু বলে যাব— ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির…উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর।’
শেষে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সাল-তারিখ মনে নেই। তবে আবছা মনে পড়ছে একবার ইস্টবেঙ্গল ১-০ গোলে এরিয়ান, কালীঘাট বা ইস্টার্ন রেলের কাছে হেরেছিল। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের শরিফ মেজাজ। তাই ওরকম একটা চুনো দলের কাছে হারের শেষে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের চোরের মতো আদর খেতে এবং তাঁবুটিকে ‘যশ’ এর পাল্লায় পড়তে হয়েছিল। যাঁদের স্মরণশক্তি ভালো, তাঁদের নিশ্চই মনে আছে।
আমাদের দেশেও কবে এমনটাই হবে….!