হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত? নাকি অনেক ভাবনা-চিন্তা, কৌশল করেই ইন্ডিয়া গেটের (India Gate) ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’র শিখা (Amar Jawan Jyoti) নিভিয়ে দিল কেন্দ্র? এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাঝেই ক্ষীণ একটা যুক্তিরেখা সাজিয়েছে নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) সরকার। কী সেই যুক্তি? ইন্ডিয়া গেটের দেওয়ালে যে সমস্ত শহিদ সেনার নাম খোদাই করা রয়েছে তা আসলে ব্রিটিশ শাসিত কলোনিয়ান ঐতিহ্যের ‘হ্যাংওভার’। অর্থাৎ প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে সমস্ত বীর সৈনিক, যাঁরা সে সময়ে আসলে দেশের স্বার্থেই প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের গৌরবগাথায় খানিক হলেও লেগে রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের হীনমন্যতা। শুধুই কি এ জন্যই এতো বড় একটা পদক্ষেপ? পঞ্চাশ বছর, অর্ধ শতকের গৌরবগাথাকে এক নিমেষে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস?
সরানোর পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের এই ‘ঝাপসা’ সওয়ালের সামনে হাজার একটা প্রশ্ন দাঁড় করানো যায়৷ কারণ, বিশ্বের কোনও ইতিহাস শূন্য থেকে শুরু হয় না৷ ঠিক তেমনি, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের এই পদক্ষেপ নিজস্ব ‘সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে’কে নষ্ট করার সমান৷ একাত্তর যুদ্ধের ৫০ বছরে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ সরানো কোথাও একটা এই দেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা গিয়ে পৌঁছবে প্রতিবেশীর হৃদয়ে। যে গৌরব অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে একদিন ওই প্রতিবেশী আত্মপ্রকাশ করেছিল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। হ্যাঁ, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে জ্যোতি সরানোর এই পদক্ষেপে৷ পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো শেষ সম্বল পড়শি বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক একইরকম হয়ে উঠতে পারে৷ সেই সম্পর্কের মধ্যে না থাকবে কোনও উষ্ণতা, না থাকবে কোনও সম্মান আর বিশ্বাস। ইন্ডিয়া গেটের জ্যোতি না নিভিয়ে বরং তার আদলে ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল ছাড়া আরও অনেক জায়গায় একই রকম স্মৃতিফলক তৈরি করা যেত৷ তাতে তো ঐতিহ্য নষ্ট হত না৷ মনে রাখতে হবে, ইতিহাসে সময় ও স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ বিগত ৫০ বছর ধরে ওই শিখা জ্বলেছে। শুধু জ্বলেছে তাই নয়, এক ঐতিহাসিক সময়ের দলিল হিসেবে সব সময় নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে এসেছে। চোখের দেখা দেখতে দেশ-বিদেশের কত মানুষ সেখানে ভিড় করেছেন। জায়গার বদলে সেই আকর্ষণ হারাতে পারে৷ মুছে যেতে পারে ইন্ডিয়া গেটের ঐতিহ্য৷
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৪ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে নিহত সেনার সম্মানে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ইন্ডিয়া গেট তৈরি করে। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে শহিদ জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ জানাতে ১৯৭২ সালে সেই ইন্ডিয়া গেটের (India Gate) সামনে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ শিখার প্রতিষ্ঠা৷ কিন্তু ইন্ডিয়া গেট ব্রিটিশ সরকারের ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যকে বহন করে, তাই সেখান থেকে অমর জওয়ান জ্যোতি সরাতে হবে, এমন ছেঁদো যুক্তি কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়৷ আর যদি ওই যুক্তিকে গুরুত্ব দিই, তাহলে রাতারাতি দেশের স্বাধীনতা এসেছিল ধরে নিতে হবে৷ ১৯৪৭ সালের আগে দেশে তৈরি ভারতীয় রেল থেকে শুরু করে একাধিক প্রতিষ্ঠানেরও বদল ঘটাতে হবে৷ তাই অমর জওয়ান জ্যোতি সরানো সঠিক কাজ হয়নি। বরং, ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালে সেই জ্যোতি মিলিয়ে কূটনৈতিক জায়গায় খানিকটা হলেও ব্যাকফুটে থাকবে ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের টিমটিম করে জ্বলতে থাকা সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে তা নিয়ে সংশয় থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তিকে সম্মান জানিয়ে অন্তত একটা বছর এই সিদ্ধান্ত পিছতে পারত৷ তাতে হয়তো বাংলাদেশ কিছু মনে করতো না। বা মনে করলেও পালটা যুক্তি দেওয়ার জায়গা থাকতো৷ সেটা তো হল না৷ সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপে বিদেশনীতি, কূটনীতি, সামরিকনীতি সমস্ত কিছুতেই সমস্যায় পড়তে পারে দেশ৷ সে সব ভ্রূক্ষেপ না করে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নষ্ট করে হয়ত অন্য কোনও লক্ষ্যপূরণ করতে চাইল মোদি সরকার।