রবিচন্দ্রন অশ্বিনের আত্মজীবনীর নাম দিয়ে দিলেন এরাপল্লী প্রসন্ন!
বুধবার বিকেলে ফোনে তাঁকে ধরা মাত্র জানতে চাইলেন, “স্টিভ স্মিথ নেমেছে ?” বুঝলাম বাড়িতে নেই। টেস্ট শুরুর দিকে কিছুক্ষণ দেখে বেরিয়ে গিয়েছেন। আর তাই এটুকু জানেন যে অশ্বিন বাদ।
আজ থেকে ৫২ বছর আগে ওভালে সিরিজের শেষ টেস্টেও বাদ পড়ে উত্তেজিত প্রসন্ন সিদ্ধান্ত নেন, অনেক হয়েছে। আর নয়। পেছনের যাবতীয় রাজনীতি এবং নিজের হতাশা উপুড় করে দেবেন অটোবায়োগ্রাফিতে। তখনকার দিনে এত দুমদাম করে পাবলিশার পাওয়া যেত না। কিন্তু দেশে ফেরা মাত্র তিনি লিখতে শুরু করে দেন যা বছরচারেকের মধ্যে ছেপে বার হয়। বই বার হওয়ার পর অনেকের মনে হয়েছিল এত আক্রমণাত্মক লেখা –এ তো মনে হচ্ছে স্পিনার নয়। ফাস্ট বোলারের জীবনী। যেভাবে বাউন্সার দিয়েছিলেন সেই সফরের ম্যানেজার হেমু অধিকারী আর ক্যাপ্টেন অজিত ওয়াদেকারকে।
তিনি অশ্বিন তো এমনিতেও বছরখানেক ধরে তিন পর্বে আত্মজীবনী লিখবেন তোড়জোড় করছেন। এদিনের অবিশ্বাস্য বাদ পড়ার ঘটনার পর কি তার কাজ দ্রুততর হবে? প্রসন্নর নিজের বইয়ের নাম ছিল, ‘ওয়ান মোর ওভার’। যেন ক্যাপ্টেনের কাছে একটা আকুতি যে আমায় আর এক ওভার অন্তত দাও। অশ্বিনের বইয়ের নাম নিজেই ঠিক করে দিলেন বেঙ্গালুরুতে বসা প্রসন্ন —‘আনফেয়ার হিস্ট্রি রিপিটস। ‘
৭৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়েও চমকপ্রদভাবে টেস্টে ফিরেছে অজিরা। ২৯৫ বলে স্মিথ-ট্র্যাভিসের রোমাঞ্চকর ২০০ রানের পার্টনারশিপ মানে টস জিতে ফিল্ড করা এবং ভারতের এগারো নির্বাচন ভয়ঙ্কর প্রশ্নের মুখে। আর তত বেশি করে প্রথম দিন মাঠের ভেতর না থেকেও বাইশ গজের সবচেয়ে বিতর্কিত-আলোচিত প্রসঙ্গ হয়ে পড়ছেন ৪৭৪ টেস্ট উইকেটধারী অশ্বিন। এমন বিপজ্জনক ফাটকা রোহিত শর্মার একার নির্ণয় হতে পারে না। দ্রাবিড় অবশ্যই এর পেছনে আসল মাথা।
সৌরভ থেকে নাসের। পন্টিং থেকে মঞ্জরেকর। বিশেষজ্ঞরা হতবাক। গাভাস্কার ভেবেই পাচ্ছেন না যে আইসিসি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তুমি তুমি আইসিসি রাঙ্কিং-এর পয়লানম্বর বোলারকে কী করে বসিয়ে দিতে পারো? আরও বিস্ময়কর যেখানে বিপক্ষে পাঁচ ব্যাটার বাঁ হাতি। সেখানে অফ স্পিনার খেলাবে না? ডব্লিউটিসি-র চলতি সাইকেলে যাঁর ১৩ ম্যাচে ৬১ উইকেট। উইকেটপিছু মাত্র ১৯.৬৭ গড়ে। তাঁকে পরিবেশ ঠান্ডা আর আকাশ মেঘলা দেখে কী করে বাইরে রাখছ? এক স্পিনার খেললেও তো জাদেজা নন–অশ্বিনের খেলা উচিত। স্পিনার হিসেবে জাদেজার চেয়ে তাঁর উইকেটসংখ্যা দুশোর বেশি। ব্যাটিংয়ে জাদেজার ৩ সেঞ্চুরি। অশ্বিনের ৫। গত দু’বছরে বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়ায় দুটো ম্যাচ বাঁচানো স্মরণীয় ইনিংস খেলেছেন তিনি। দ্রাবিড় কী করে ভুলে গেলেন? নাকি এটাই ফাটকার ধরণ? ঝুঁকি বেশি থাকবে তেমনি প্রফিটও।
গ্রেগ চ্যাপেল যখন কোচ এবং দ্রাবিড় ক্যাপ্টেন। এইরকম চমকে দেওয়া ফাটকা ভারত বেশ কিছু খেলেছে। কিছু ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনার সংস্কার হয়েছে। কিছু হয়নি। ওভালের ফাটকার ভবিষ্যৎ কী হয় ক্রিকেট বিশ্ব এখন গবেষণায় ব্যস্ত। স্ত্রীবিয়োগের পর বিষন্ন অশীতিপর প্রসন্ন যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এত দূরে থাকা এক মানুষ। কিন্তু তাঁর জিজ্ঞাস্য, “ওভালে প্রথম দু ঘন্টা মেঘলা আকাশ দেখে অল আউট চলে যাওয়া কি ঠিক? লাঞ্চের পরেই তো রোদ্দুর উঠে যাবে। কতবার হয়েছে।”
ম্যাচে ঠিক তাই হল। যে পরিবেশ ও সারফেস দেখে বিপক্ষ ক্যাপ্টেন ফিল্ডিং নিয়েছেন, সেখানে ট্র্যাভিস হেড ১০৮ বলে সেঞ্চুরি করে গেলেন। অতীতে ভারত তাঁকে একাধিকবার আউট করেছে শর্ট বল করে। গায়ের ওপর ওঠা বলে যে তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না এটা কেনিংটন ওভাল ইংল্যান্ডে অবস্থিত এক ক্রিকেট মাঠ -এমনি ক্রিকেটসার্কিটে স্বতঃসিদ্ধ। সিরাজের একটা শর্টপিচে তিনি গায়ে খেলেনও। কিন্তু তার পর ট্র্যাভিস হেডকে আবার বাউন্সার করা হল যখন তিনি নব্বইয়ের ঘরে। কপিল দেব নিশ্চয়ই দর্শকাসনে ভাবছিলেন ,নতুন বল নিয়ে এই পরিবেশে চার পেসারের কী ধ্যাষ্টামো হচ্ছে? রবি শাস্ত্রীকে বলতে শোনা গেল, “অভিজ্ঞতা থেকে ইন্ডিয়া কিছুই শেখেনি দেখেছি। ট্র্যাভিসকে প্রথম ৪০ রান এমনভাবে মিষ্টি বেলানো হলো যেন দিওয়ালি চলছে। আর সামিরা দু মাসের আইপিএল খেলে এসে হাঁটছে দ্যাখো। যেন দু’বছরের ক্লান্তি নিয়ে বল করছে।” বহুবছর কোনো ভারতীয় ভাষ্যকারকে ভারতের ম্যাচে এমন তীব্র সমালোচনা করতে শুনিনি। ট্রেসার বুলেটের মতো যাচ্ছিল কথাগুলো। লক্ষ্য অবশ্যই ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট।
ওভাল এমনিতে দ্রাবিড়ের প্রিয়তম ইংরেজ সারফেস। এখানে তাঁর মনোহারী সেঞ্চুরি-ডাবল সেঞ্চুরি রয়েছে। কিন্তু এমন ঝুঁকিপূর্ণ কম্বিনেশন এবং টস জিতে স্বেচ্ছায় ফোর্থ ইনিংসে বল করার সুযোগ ছাড়া বুমেরাং হবে না তো? স্মিথ- হেড-দের ফোর্থ উইকেট পার্টনারশিপ শুধু অস্ট্রেলিয়াকে সলিড অবস্থানে বসিয়ে দেয়নি। ইংল্যান্ডের শতাব্দী প্রাচীন মাঠে এক আশংকার জন্ম দিয়েছে যে ৩৫০ তাড়া করার মতো ব্যাটিং আছে তো ভারতের? ধরে নিচ্ছি সেকেন্ড ডে উইকেট এরকমই থাকলো। রোদ্দুরে ভরে থাকল এদিন দর্শকাসন যথেষ্ট ফাঁকা থাকা ওভাল। কোহলি-গিলরা চমৎকার ব্যাট করলেন। ওভাল ঢেকে গেল উপমহাদেশীয় ব্যাটিং লাবণ্যে।
কিন্তু কোথাও গিয়ে তো লোয়ার অর্ডারের সাহায্য লাগবে। ময়দানের ভাষায় এখানেই প্রশ্ন —তার জন্য দোকানে মাল আছে তো? শিখর ভরত ভালো কিপ করেছেন। সেট হতে শুরু করা ওয়ার্নারের ক্যাচটা দারুণ। কিন্তু ব্যাটিং-এ তাঁর ওপর আশা রাখা যাবে? এর পর একে একে শামি। উমেশ। শার্দুল। সিরাজ। শার্দুলের একটা ভালো ইনিংস অতীতে থেকেও বলা যায় ,শেষ পাঁচজন প্রায় ব্যাট করে না। এ বলে আমায় দ্যাখ। ও বলে ব্যাট হাতে আমায় দেখ। চাপের মুখে তারা কি জীবন্ত হয়ে যাবে হঠাৎ করে?
ক্রিকেটে কত বিচিত্র কিছু হয়। তবু ফেলুদার যেন মনে হবে, ভালো লাগছে না রে তোপসে!