এমনিতেই রাজনৈতিক নেতাদের কথায় মানুষ খুব একটা গুরুত্ব দেন না, কারণ প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে মানুষ ক্লান্ত। রাজনৈতিক নেতা মাত্রেই যে মিথ্যে বলেন তা নিয়েও মানুষের কোনও দ্বিমত নেই। আর সে রাজনৈতিক নেতা যদি আবার বিজেপির হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। দলের নেতাই যদি এক প্যাথোলজিক্যাল লায়ার হয়, সে দলের বাকি নকড়া ছকড়ারা যে মিথ্যেই বলবে, সেটা তো ন্যাচরাল, খুব স্বাভাবিক। এ রাজ্যে বিজেপির নেতা যে ঠিক কে, তা নিয়ে বিস্তর ধোঁয়াশা আছে। দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার আর শুভেন্দু অধিকারীর মধ্যে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে, খুব শিগগির সেই প্রতিযোগিতা থামবে? না মনে হয় না। তাই তিনজনেই মুখে মারিতং জগত, তিনজনেই কিছু করে নয়, কিছু বলে ভেসে থাকতে চান, মিডিয়াতে ভাসা আর কী। প্রতিদিন এই তিনজনের কেবল বিবৃতি আমরা শুনি, বিবৃতিতেই ঘুমিয়ে পড়েন, বিবৃতিতেই জেগে।
আজ ছিল তেমনই এক বাতেলার দিন, আজ ছিল শুভেন্দু অধিকারীর পালা। সিঙ্গুরে গিয়ে দিন তিনেক আগে বলেছেন, জাতীয় দলের তকমা কেড়ে নেওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি অমিত শাহকে সাধাসাধি করেছেন, যাতে ওই জাতীয় দলের তকমা রেখে দেওয়া যায়। গতকাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, এ তথ্য মিথ্যে, যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব। শুনেই কাল শুভেন্দু জানালেন আগামীকাল বিফিটিং জবাব দেব, যাকে বলে মুহতোড় জবাব, মানে বোমা ফাটাবেন শুভেন্দু। মানুষ এবং মিডিয়া ১২ ঘণ্টা চোখের পাতা এক করেনি। শুভেন্দু এলেন ক্যামেরা চলল, বোঝা গেল, ওনার ঝোলা শূন্য, উনি একটা ধানি পটকার আওয়াজও তুলতে পারলেন না। এটাই আমাদের বিষয় আজকে।
প্রথমে আসুন বিষয়টাকে একটু অন্য দিক থেকে দেখা যাক। এমনিতে আপাতত অমিত শাহ মমতা সম্পর্ক তেমন জায়গায় নেই যেখানে একজন অন্যজনকে ফোনে অনুরোধ জানাবেন। এক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে মুখ্যমন্ত্রী, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন সম্পর্ক হওয়া উচিত নয়, কিন্তু এটাই বাস্তব অবস্থা। তারপরেও ধরে নিলাম একজন অন্যজনকে ফোন করেছেন। নৈতিকতার কোন স্তরে গেলে তা নিয়ে তৃতীয় একজন প্রকাশ্যে কথা বলেন? অত্যন্ত নিম্নরুচি, অত্যন্ত নিম্নমানের ইত্যাদি বলেও বোঝানো যাবে না যে শুভেন্দু অধিকারী যা বলেছেন, তা কতটা কদর্য। অবশ্য দল নির্বিশেষেই রুচি, নৈতিকতা ইত্যাদি যে কবেই গড়ের মাঠে ঘাস খেতে গিয়েছে তা আমরা জানি। তো মমতা বললেন প্রমাণ দিন। মিডিয়াতে ভেসে থাকার জন্যই শুভেন্দু জানালেন দেব, আগামিকাল বিফিটিং জবাব দেব। আমরা ভেবেছিলাম তাহলে সম্ভবত নীতি নৈতিকতার সীমা পার করেই টেলিফোন রেকর্ডিং শুনিয়ে দেবেন শুভেন্দু। কিন্তু তিনি প্রেস কনফারেন্সে এসে আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে ইত্যাদি বকে গেলেন, যা বললেন তা হাস্যকর। কিন্তু ওই যে লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়, লজ্জা নিয়ে তো রাজনীতি করা যায় না। উনি চেয়েছিলেন সাংবাদিক আসুক, ক্যামেরা আসুক গন্ডায় গন্ডায়, এসেছে। লাইভ ট্রান্সমিশন হয়েছে। নটে গাছটি মুড়িয়েছে, ওনার কথা ফুরিয়েছে।
আরও পড়ুন: Aajke | দশ আঙুলে দশ আংটি, যখন যেটা কাজে লাগে
নির্বাচন কমিশনের এক লিখিত নিয়ম আছে, সে নিয়ম অনুযায়ী কিছু দল জাতীয় দল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, কিছু দল রাজ্যের দল হয়ে থাকবে। এই লিখিত নিয়ম নিয়ে হাজার প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে কিন্তু তার পরেও তৃণমূল একটা আঞ্চলিক দল, বাংলায় সে দল প্রশ্নাতীতভাবেই বড় এবং জাতীয় রাজনীতিতে তার সাংসদ বিধায়ক সংখ্যা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বিজেপি বিরোধী যে জোটই গড়ে উঠুক না কেন, সেখানে তৃণমূলের এক বড় ভূমিকা তো থাকবেই। সেই দলের নেত্রী খামোখা ওই জাতীয় দলের তকমা রাখার জন্য দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে সাধাসাধি করবেন কেন? শুভেন্দু একথা বলার সময় বোধহয় ভুলেই গিয়েছিলেন এতবড় কথা বলার পেছনে যথেষ্ট প্রমাণ থাকাটা বড্ড জরুরি বা তিনি আপাতত এরকমই উৎপটাং কিছু বলে নিজের প্রাসঙ্গিকতা এবং দলে সুপ্রিমেসি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন? এবং তা করতে গিয়ে তিনি কি তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছেন না? কী বলছেন মানুষজন।
প্রবীণদের মনে আছে, আমিও শুনেছি এক প্রবীণ সাংবাদিকের মুখেই। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তখন বালক ব্রহ্মচারীর অনেক শিষ্য। আর বালক ব্রহ্মচারী মাঝে মধ্যেই মিডিয়ার কাছে বলতেন, নেতাজি বেঁচে আছে। আলকাতরা দিয়ে দেওয়ালে লেখা হত, নেতাজি ফিরে আসবেন। বেশ কিছুদিন এসব চলার পরে এ নিয়ে বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হয় ওই বালক ব্রহ্মচারী আর তার সন্তান দল। এমনকী শোনা যায়, দলের মধ্যেও প্রশ্ন উঠতে থাকে, সেরকম এক সময়ে হঠাৎই আগুনের মতো ছড়িয়ে যায়, এক ২৩ জানুয়ারি নেতাজি ফিরে আসছেন, শহীদ মিনারে জনসভায় তিনি থাকবেন। লক্ষ মানুষ হাজির হয়েছিল, নেতাজি আসেননি। বালক ব্রহ্মচারী মুখ বাঁচাতে বলেছিলেন, যথেষ্ট সিকিউরিটি ব্যবস্থা না থাকায় নেতাজিকে আনা গেল না। কেউ বিশ্বাস করেনি। এরপর ওই সন্তান দল এবং বালক ব্রহ্মচারী ক্রমশ মুছে যেতে থাকে। আবার ক’দিনের জন্য জেগেছিল বালক ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর পরে, বলা হয়েছিল বাবা মরেননি। শেষে তারও পরিসমাপ্তি হয় আরও হাস্যকরভাবে, সন্তান দল মুছে গেছে। রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা এক বড় ব্যাপার, শুভেন্দু অধিকারী সম্ভবত এটা জানেন না।