এই নিয়ে দু’ দু’ বার শরদ পাওয়ার বুঝিয়ে দিলেন যে ভারতীয় রাজনীতিতে অন্য কেউ নয় তিনিই চাণক্য। অজিত অনন্তরাও পাওয়ার, মহারাষ্ট্রে পরিচিত অজিত দাদা নামে, উনি শরদ পাওয়ারের বড়ভাই অনন্তরাও পাওয়ারের ছেলে, এনসিপির মহারাষ্ট্র রাজনীতির অন্যতম মুখ। তিনি সাতসকালে চলে গিয়েছিলেন রাজভবনে, বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবিশ মুখ্যমন্ত্রী, অজিত পাওয়ার উপমুখ্যমন্ত্রী, শপথ নিয়েছিলেন। দেশসুদ্ধ সাংবাদিক থেকে সাধারণভাবে রাজনীতির খবর রাখা মানুষ চমকে উঠেছিল। শরদ পাওয়ারকে ডিঙিয়ে, দল ভেঙে একজন উপমুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেল? ক’দিনের মধ্যেই বোঝা গেল, দলের আসল চাবিকাঠি শরদ পাওয়ারের হাতেই আছে, চাণক্য ক’দিনের মধ্যেই তাঁর কূটনীতির পরিচয় দিলেন। উনি এক অসম্ভব জোট, যে জোটে শিবসেনা, কংগ্রেস, এনসিপি আছে, এক মার্ক্সিস্ট দল পিজান্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি আছে, যাদের পতাকায় কাস্তে হাতুড়ির সঙ্গে তিনটে তারা আছে, সমাজবাদী পার্টি আছে, স্বাভিমানী পক্ষ আছে, এনারা বহু আগের শ্বেতকারী সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসা লোকজন এবং সিপিআইএম আছে। সবমিলিয়ে মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি। কী কাণ্ড একবার ভাবুন, একটা জোট, সেই জোটে দক্ষিণপন্থী চিন্তা আছে, ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের চিন্তা আছে, জাতীয়তাবাদী চিন্তা আছে, গান্ধীবাদী চিন্তা আছে, আম্বেদকরের শিষ্যরা আছেন, উদারবাদীরা আছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে, হিন্দুত্ববাদীরা আছেন, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা আছেন। কিন্তু এক উপাদেয় খিচুড়ি। শরদের নেতৃত্বেই এই সব দলগুলো একসঙ্গে জোট বেঁধেছে, জোট চলেছে, শিন্ডে শিবসেনা ভেঙে বেরিয়ে গেলেও জোট ভাঙেনি। জোট আছে। এবং এরকম জোট এই প্রথম নয়, ১৯৭৮-এ কংগ্রেস ভেঙে জনা ৩০ এমএলএ নিয়ে, একধারে জনসঙ্ঘীদের, অন্যধারে মার্ক্সিস্ট ওই পিজ্যান্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টিকে নিয়ে সরকার তৈরি করেছিলেন। ওনার বাড়ি সিলভার ওক-এ জ্যোতি বসু গিয়েছেন, বৈঠক করেছেন, সেও আরেক মিলিজুলি সরকারের প্রস্তুতি পর্ব ছিল। আদতে নাস্তিক শরদ পাওয়ারের সঙ্গে দেশের প্রত্যেক বড় রাজনৈতিক নেতার সুসম্পর্ক, যে কোনও সময় যে কাউকে তিনি সরাসরি ফোন করতে পারেন। প্রত্যেক শিল্পপতির সঙ্গে তাঁর একই রকম ঘনিষ্ঠতা, বিপক্ষের প্রতিটা দল যখন আদানি নিয়ে সরব তখন তিনি লুকিয়ে ছুপিয়ে নয়, প্রকাশ্যেই আদানির সঙ্গে দেখা করলেন, আবার বিজেপির বিরোধিতা বা বিরোধী ঐক্যের কথাও বলে যাচ্ছেন। এটাই শরদ পাওয়ার।
কিন্তু কিছুদিন হল ওনার দলের মধ্যে আবার একটা মতামত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। আসলে অজিত পাওয়ারের, তাঁর পরিবারের কিছু মামলা আছে, যা নিয়ে যে কোনও মুহূর্তেই সিবিআই ইত্যাদি অ্যাকটিভ হয়ে উঠতে পারে। ওদিকে বিজেপি আগামী লোকসভা ভোটের আগেই মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়িকে ভাঙতে চায়। কারণ খুব সোজা, গতবার বিজেপি শিবসেনা জোট ৪৮টা সাংসদের মধ্যে ৪১টা পেয়েছিল, বিজেপি একাই পেয়েছিল ২৩টা, শিবসেনা ১৮টা, এনসিপি ৪টে, কংগ্রেস ১টা আর এমআইএম পেয়েছিল ১টা আসন। এবার যদি শিবসেনা উদ্ধব গোষ্ঠী, কংগ্রেস, এনসিপি, বামেরা মিলে লড়ে তাহলে ৪৮টাতে গোটা ১২ আসনের বেশি পাবে না বিজেপি, এটা বিজেপির নিজেদের হিসেব। তাই ভাঙতে হবে মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়িকে। কংগ্রেসকে আর ভাঙা সম্ভব নয়, শিবসেনাতে যারা রয়ে গেছে তাঁরা বিজেপির সঙ্গে যাবে না, বামেদের যাওয়ার প্রশ্নই নেই, রইল বাকি এনসিপি। এই এনসিপির সবথেকে দুর্বল জায়গাটা হল অজিত পাওয়ার, দুর্বলতাও আছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। কাজেই কথাবার্তা চলছিল। তিনি নিজের বই, লোক মাঝে সাংঘাতি, মানুষের সঙ্গে আমি, বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের প্রায় প্রত্যেক নেতাকে ডেকে আনলেন, বই নিয়ে কথা শেষ করেই আচমকাই বললেন পদত্যাগ করছি। সঙ্গে সঙ্গে হাই পিচ ড্রামা, কান্নাকাটি, গায়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা সবই হল। শরদ পাওয়ার পদত্যাগের কথা বলে গোটা দলটাকে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে শক্তি পরীক্ষা করে নিলেন, শক্তি দেখিয়েও দিলেন। আপাতত ভাঙন প্রচেষ্টা বন্ধ হল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বজরং দল, বজরংবলী আর সোনার মেডেল পাওয়া কুস্তিগিরের দল
কিন্তু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। আর সে সমস্যাটা সবথেকে ভালো বুঝেছে আরএসএস–বিজেপি। সমস্যাটা হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বংশানুক্রমিক রাজনীতির চেহারা। গোটা দেশজুড়ে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলের কমন ফ্যাক্টর হল বংশানুক্রমিক রাজনীতি। বাদ কেবল কমিউনিস্ট পার্টি, তো সে দল আপাতত কেরলে, তাও সেখানে লড়াই বিজেপির সঙ্গে নয়। অন্যদিকে আপ, কিন্তু যে দ্রুততার সঙ্গে আপ মেন স্ট্রিম পলিটিক্স-এর দুর্নীতি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে, তা দুর্ভাগ্যজনক কেবল নয়, বিজেপির কাছে বেশ স্বস্তিদায়কও বটে। কিন্তু এই দুই পক্ষ বাদ দিলে গোটা দেশের চেহারা দেখুন। মল্লিকার্জুন খাড়্গে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি, একজনও বিশ্বাস করে যে উনি নিজের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী? কেবল দলের সভাপতি নির্বাচনে লড়েছেন, এই দায় নিয়েই শশী থারুরের মতো বলিয়ে কইয়ে নেতা আজ অপাংক্তেয়। জওহরলালের পর ইন্দিরা তবু মানা যায়, কিন্তু রাজীব? তারপর সোনিয়া? তারপর রাহুল? কংগ্রেস গান্ধী ছাড়া চলতে পারে না, এটা ঐতিহাসিক তথ্য। চলুন কাশ্মীর। মুফতি মহম্মদ সইদের কন্যা মেহবুবা মুফতি, দলের নাম পিডিপি। অন্যদিকে শেখ আবদুল্লা, ফারুক আবদুল্লা, ওমর আবদুল্লা, ন্যাশনাল কনফারেন্স। চলে আসুন মহারাষ্ট্রে, বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র উদ্ধব ঠাকরে। তাঁর পুত্র এখন মাঠে আদিত্য ঠাকরে। এনসিপির শরদ পাওয়ারের কন্যা সুপ্রিয়া সুলে, ভাইয়ের ছেলে অজিত পাওয়ার। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী দল, লাল টুপি, কিন্তু বাবার আসনে তাঁর ছেলে, মুলায়মের পর অখিলেশ যাদব, তাঁর বউ ডিম্পল যাদব এখনই রাজনীতিতে, কাকা তো পুরনো খিলাড়ি শিবপাল যাদব। বিহারে লালু যাদব, পুত্র তেজস্বী যাদব, মেয়ে মিসা যাদব আর এক পুত্র তেজপ্রতাপ যাদব। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ওড়িশাতে বিজু পট্টনায়কের পুত্র নবীন পট্টনায়ক। অন্ধ্রতে ওয়াইএসআর রেড্ডির পুত্র জগন রেড্ডি, দলের নামই ওয়াইএসআর কংগ্রেস। তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে কে টি রামা রাও ক্যাবিনেট মন্ত্রী, মেয়ে কবিতা সাংসদ ছিলেন, এখন এমএলসি। তামিলনাড়ুর প্রবাদপ্রতিম নেতা এম করুণানিধির ছেলে হওয়ার ৪ দিন পরে রাশিয়ার নেতা জে ভি স্তালিন মারা যান। ৫ মার্চ ১৯৫৩, পয়লা মার্চ জন্ম নেওয়া পুত্রের নাম রাখা হয় স্তালিন, মুথুভেল করুনানিধি স্তালিন, তিনি আপাতত মূখ্যমন্ত্রী। স্তালিনের পুত্র রাজ্যের ক্রীড়া যুব উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী, বোন কানিমোঝি সাংসদ, দাদা আলাগিরি দল চালান, সব মিলিয়ে জমজমাট বংশানুক্রমিক শাসন।
আর এইখানেই বিজেপির সুবিধে। কমিউনিস্টরা এমনিতেই শক্তি হারিয়েছে, আপ দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে, বাকি বিরোধীদের সর্বত্রই বংশানুক্রমিক শাসন। এবং সে দলগুলো ভাঙার সবথেকে সুবিধে হল দলের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী থাকবেই, আছেও, তাদেরকে খুঁজে বার করা, দলের সেই ক্ষমতাবান পপুলার নেতাকে চিহ্নিত করা যে দলের নেতা হতে চাইছে, কিন্তু নেতা বা নেত্রীর বংশের কেউ নয় বলেই পিছিয়ে যাচ্ছে। কতদিন সেই নেতা তিন নম্বর কি চার নম্বর হয়ে থাকবে, তার চোখের সামনে দিয়ে সেই নেতা, যিনি দলনেতা বা নেত্রীর আত্মীয়, তিনি হুস করে এসে দলের নেতা হয়ে বসবেন, তাঁকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে। সেই নেতাকে খুঁজে বার করে টোপ দেওয়াটাই কাজ বিজেপির। অবশ্যই কার্যসিদ্ধি হয়ে গেলে নটে গাছটি মুড়িয়ে যাবে, মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার যদি গোটা ৩০ এমএলএ নিয়ে বিজেপিকে সমর্থন দেয়, তাহলে ওই শিন্ডেকে ছুড়ে ফেলে দিতে বিজেপি এক মুহূর্ত সময় নেবে না। শিন্ডেও সম্ভবত সেটা বুঝেছে। কিন্তু সারা দেশের রাজনৈতিক দলে তো উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতার অভাব নেই, সেটাই বিজেপির আপাতত লক্ষ্য। কর্নাটকে হারলে তারা সর্বশক্তি নিয়ে হিন্দু মুসলমান মেরুকরণে নামবে, নিয়ে আসবে ইউনিফর্ম সিভিল কোড বিল, আনবে জঙ্গি জাতীয়তাবাদী স্লোগান, লো ইনটেনসিটি ওয়ার, মানে হালকা যুদ্ধের আবহ তৈরি হতেই পারে। কিন্তু এসবের উপরে সারা দেশজুড়ে বিরোধী দলগুলোকে ভেঙে টুকরো করার কাজ শুরু হয়ে গেছে, আর বিজেপি এই কাজ করতে সক্ষম কারণ বিরোধী দলগুলোতে বংশানুক্রমিক রাজনীতির নগ্ন চেহারা। রাজস্থানে শচীন পাইলট হতেই পারে তাঁদের তুরুপের তাস, বিআরএস-এর কিছু নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বিজেপি, আমাদের রাজ্যেও কি তাদের নজর নেই? আছে বইকি। এক শুভেন্দুতে তো কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না, আরও শুভেন্দু খোঁজা চলছে। ঘরে যদি ফুটো থাকে, সে ছিদ্র দিয়ে সাপ ঢুকবে তা জানার জন্য তো খুব বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না।