গোটা বিশ্বের রাজনীতিবিদদের টিকে থাকার অন্যতম ভরসা হল মানুষের পুওর মেমোরি, চট করে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা। নাজিম হিকমতের লেখা জেলখানার চিঠি অনুবাদ করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তাতেই ছিল, বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর। হ্যাঁ, এটাই রাজনীতিবিদ, আরও ভালো করে বললে সমস্ত স্বৈরতন্ত্রী শাসকেরা এটাই মনে করেন, নরেন্দ্র মোদি তার ব্যতিক্রম নয়। উনি ভাবছেন মণিপুর ভুলতে মানুষ সময় নেবে বড়জোর মাস তিন চার, তার মধ্যে হাজার একটা ইস্যু এসে হাজির হবে, আপাতত চুপ থেকেই বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া ভালো। যেভাবে আদানি ইস্যু উনি এড়িয়ে গিয়েছেন, ডিমনিটাইজেশন ইস্যু এড়িয়ে গিয়েছেন, সেইভাবেই মানুষ মণিপুর ভুলে যাবে। উট বা উটপাখি বালুতে মুখটা গুঁজে দিয়ে ভাবে বালুঝড় থেমে গেছে, সেরকমটা উনি সমস্যা দেখলেই নার্ভাস হন, কী বলবেন জানা নেই, করার কিচ্ছু নেই তাই মৌনতাই ওনার ভরসা হয়, ৫৬ ইঞ্চির ছাতির বুক ঠুকে কথা বলা সব বন্ধ। এটা শাসকের চরিত্র, কম বেশি প্রত্যেক শাসকের, এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠলেই মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো, সংবাদমাধ্যমের সামনে চলে যাওয়া, গন্ডগোলের জায়গাতেই হাজির হয়ে যাওয়া এসব ব্যতিক্রম, এসব কোট আনকোট রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দেখা যায় না। দেখুন না, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এই গোটা সময়ের মধ্যে ইম্ফলের বাইরে বের হতে পারেননি। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অমিত শাহ গিয়েছিলেন মণিপুরে, তিনিও ইম্ফলের বাইরে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে না নিয়ে। অথচ এই অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলেননি। তাই বলছিলাম, বিজেপি-আরএসএস, মোদি–শাহ মণিপুরের ঘটনাকে ভুলে যেতে চাইছেন, ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। যেভাবে বিস্মৃতিরও ওপারে চলে গেছে নেলীর গণহত্যা, গুজরাতের গণহত্যা, শিখ গণহত্যা সেভাবেই মানুষ ভুলে যাক মণিপুরের এই জাতিদাঙ্গা। এই বর্বর অধ্যায়, যা ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট আর রাজ্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তার জন্যই ঘটেছে।
কিন্তু সে তো রাজনীতির কথা, সে তো সরকারের কথা কিন্তু মানুষও কি ক্রমশ বোবা, আত্মকেন্দ্রিক আর অসংবেদনশীল হয়ে উঠছে? নাকি মণিপুরে কী ঘটল, কী ঘটছে তা নিয়ে ভারতবাসী সহনাগরিকদের কোনও মাথাব্যথাই নেই। ইতিহাস বলছে, হিটলারের প্রথম দিকের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প মিউনিখের কাছে দাহাউয়ে তৈরি হয়েছিল ১৯৩৩-এ, এরপরে ব্রিটেনের সঙ্গে হিটলারের আলোচনা হয়েছে, শান্তির আলোচনা, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। ১৯৩৬-এ সামার অলিম্পিক্স জার্মানিতেই হয়েছে, রাশিয়া-জার্মানি অনাক্রমণ চুক্তি হয়েছে, গোটা পৃথিবীর মানুষ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নিয়ে একটা কথাও বলেননি, কোথাও কোনও প্রতিবাদ হয়নি। মিউনিখ থেকে ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরের অখ্যাত দাহাউতে সেদিন কী হচ্ছিল কেউ তার খবর রাখেনি, লোকের নজর ছিল বার্লিনে। চলুন হিরোশিমায়, নাগাসাকিতে, সেখানে কী হয়েছিল জানতে পৃথিবীর মানুষের এক বছর লেগেছিল। জন হার্সে, একজন সাংবাদিক গ্রাউন্ড জিরোতে গিয়ে জানালেন পরমাণু বোমার বীভৎস প্রভাবের কথা, গোটা পৃথিবী শিউরে উঠেছিল। সেই সাংবাদিক না গেলে? প্রতিবাদ হত? কেউ জানতেন না? সে দুনিয়াতে সিআইএ ছিল, কেজিবি ছিল, মোসাদ ছিল, কেউ জানতেন না? ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ ঘটেছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, টুকরো কিছু খবর গিয়েছিল গান্ধীর কাছে, তিনি এক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম তৈরি করে পাঠিয়েছিলেন যাঁদের ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। সেই খবর রবি ঠাকুরের কাছেও এসেছিল, তিনি তাঁর নাইটহুড ত্যাগ করেন এবং অ্যান্ড্রুজকে পাঠান খবর নিতে। তিনি কিছু খবর পাঠান কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই তাঁকেও পঞ্জাব থেকে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু কবির নাইটহুড ত্যাগের খবর ছড়িয়ে যায় গোটা বিশ্বে এবং মানুষ জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। জুন মাসে জওহরলাল নেহরু ঘটনাস্থলে যান এবং তারপর গোটা ভারত জুড়ে তার প্রতিবাদ শুরু হয়। মানে কবির প্রতিবাদের আগে মানুষের হুঁশ ফেরেনি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | RSS – BJP – মোদি – শাহ ক্ষমতায় থাকার জন্য কোন রাস্তা ধরবেন?
স্বাধীনতার পরেও তাই, কাকদ্বীপের অহল্যা মা আর কৃষক আন্দোলনের কথা থেকে পরবর্তীতে বহু আন্দোলন, বহু প্রতিবাদের ক্ষেত্রে হাতিয়ার হয়েছেন কবি, সাহিত্যিক সাংবাদিক, সিভিল সোসাইটির মানুষজন। মনে আছে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের কথা, সারা দেশ রাস্তায় নেমেছিল, মনে আছে সিএএ-এনআরসির কথা, সেদিন কি কেবল কুণ্ঠিত মুসলমানেরা পথে ছিলেন? না তো। সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক অভিনেতা, গায়ক, বলেছিলেন কাগজ নহি দিখায়েঙ্গে, সরকার পিছু হঠেছিল, সেই সিভিল সোসাইটি আজ কোথায়? কোন কবি এগিয়ে এসে বললেন আমার খেতাব ফেরত নিন? কোন সাহিত্যিক সেই প্রতিবাদকে সমর্থন জানালেন? কোথায় জেএনইউ আর আলিয়ার ছাত্ররা? কোথায় কমিউনিস্ট আর সমাজতন্ত্রীরা? কেবল নেতারা প্রতিবাদে নামবেন? যে নেতাদের কারও হাতে নেলীর দাগ রয়েছে, শিখ গণহত্যার দাগ রয়েছে বা এই মোদি-শাহের সঙ্গে ঘর করার ইতিহাস রয়েছে, কেবল তাঁরাই করবেন প্রতিবাদ নাকি দেড়শো জনের মৃত্যুর কোনও ওজন নেই কারণ তাদের নাক চ্যাপ্টা আর রং সামান্য হলদেটে, সেই কারণে? কারণ ধর্ষিতা হয়েছেন যাঁরা তাঁদের প্লেন ল্যান্ডের মানুষজন দেশের মানুষ বলেই মনে করেন না। মঙ্গোলয়েড মাত্রই বেশিরভাগ মানুষ বলেন, ওই যে নেপালি যায়। ৬০ হাজার মানুষ গৃহহীন আশ্রয়হীন হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, অথচ দেশের রাজপথে প্রতিবাদ নেই? আকচা আকচি চলছে কী নিয়ে? মালদা বড় না মণিপুর বড়? রাজস্থানের নারী নির্যাতন বড় না মণিপুরেরটা বড়? টিভি চ্যানেলে খেলা থেকে নতুন সিনেমা, ভূতের গল্প থেকে অনলাইন গেম খেলে কোটিপতি হওয়া আর বিকাশ উন্নয়নের ধারাবিবরণী উপচে পড়ছে, মণিপুর আপাতত এক সংসদীয় আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা আমাদের সহনাগরিকদের গণহত্যা বা গণধর্ষণ নিয়ে মোটেও চিন্তিত নেই। এর দশভাগের এক ভাগ যদি রাজধানী, কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ বা লখনউতে হয়ে যেত, তাহলে দেখতেন প্রতিবাদ কাকে বলে, গোটা দেশের মোমবাতি একদিনে জ্বলে উঠতো, আর ঠিক এইখানেই লুকিয়ে আছে আজকের মণিপুরে জাতিদাঙ্গার রহস্য।
গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই কারও কোনও ভাবনাচিন্তা নেই, কারও না। উত্তর পূর্বাঞ্চলের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার স্বঘোষিত রাজাদের কাউকে চোখ রাঙিয়ে, কাউকে প্রলোভন দেখিয়ে ভারতবর্ষের সঙ্গে জুড়ে তো নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের জাতিসত্তার প্রশ্নগুলোর কোনও সমাধান করার চেষ্টা কোনওদিনও হয়নি। মণিপুরের রাজাকে মনে করা হয়েছে গোটা মণিপুরের রাজা, কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলে নাগারা নাগালিম, নাগাদের জন্য স্বাধীন এলাকা, অঞ্চলের দাবি তুলেছেন, তার সমাধান হয়নি, কুকি চিন জো-রা তাদের জোগম নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন আর মেইতিরা চাইছেন বৃহত্তর মণিপুর। প্রত্যেকটাই প্রত্যেকের সঙ্গে স্ববিরোধী, কাজেই সমস্যা মেটেনি। এরমধ্যে মেইতিরা আলাদা রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে লড়েছে বহুদিন, আজও তাদের সেই দাবি তারা ছাড়েনি। তাদের সশস্ত্র গ্রুপ আছে, তারাও ট্রেনিং পায়, দেশের মধ্যেই তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়, সরকার সব জানে। অন্যদিকে কুকি চিন জো-দের কম বেশি ২০টা এরকম সশস্ত্র গোষ্ঠী আছে, তাদের মিলিটারি ট্রেনিং আছে, তারা বার্মা বা মায়ানমার বর্ডারে তাদের ট্রেনিং ক্যাম্প চালায়, তাদের সঙ্গে এই বিজেপি সরকারের অনাক্রমণ চুক্তি আছে, এ চুক্তি সই হয়েছিল ২০০৮-এ মনমোহন সরকারের সঙ্গে। এঁরা ক্যাম্পে থাকেন, অস্ত্র ট্রাঙ্কে ভরে একটা চাবি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর একজনের হাতে দিয়ে অন্যটা নিজেদের সামরিক নেতাদের হাতে দিয়ে সরকারি পয়সায় ঘুরে বেড়ান। নাগাদের সামরিক গোষ্ঠী পামরা বিখ্যাত, তাদের হাতেও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে, রকেট লঞ্চার থেকে মাইন সব আছে। এইসব ইনসার্জেন্সি গ্রুপের আবার কাউন্টার ইনসার্জেন্সি গ্রুপ আছে, তাদের টাকা, প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র জোগায় স্টেট, রাষ্ট্র সব জানে। এই কুকিদের একটা গ্রুপ ইউকেএলএফ-এর একটা চিঠি আমাদের হাতে আছে, যেখানে সেই সামরিক গ্রুপের নেতা চিঠি লিখছেন অমিত শাহকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। চিঠিতে বলছেন কীভাবে তাঁরা নির্বাচনে বিজেপিকে জিততে সাহায্য করেছেন, কোন কোন নির্বাচনে জিততে সাহায্য করেছেন। লিখছেন একজন বিজেপি এমএলএ-র কথা যিনি ১০টা পিস্তল সরকারি অস্ত্রাগার থেকে চুরি করে বাজারে বিক্রি করেছিল এবং কীভাবে সেগুলো তাদের কাছে এসে পৌঁছয় এবং কীভাবে তারা সেগুলো সরকারকে দিয়ে দিতে রাজি আছে। মানে খুব পরিষ্কার, সরকারের কাছে এদের যাবতীয় তথ্য আছে, এদেরকে কিচ্ছু করা হয় না ভোট রাজনীতির জন্যই এবং আজ সেই রাজনীতির এক বহিঃপ্রকাশ হল এই জাতিদাঙ্গা। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমস্যার সমাধান করার ধৈর্য, মেধা বা পরিশ্রম করার ক্ষমতা কারও কাছে নেই, অতএব ধামাচাপা দিয়ে যেমন চলছে চলুক। মেইতিরা কুকি মারুক, কুকিরা মেইতি মারুক রাষ্ট্রের কিছু এসে যায় না, দেশের মানুষের কিছু এসে যায় না। আর সেই সুযোগটা নিয়েছেন আমাদের প্রধানসেভক, তিনি মৌনতার আড়াল দিয়ে এই বর্বরতাকে ঢাকার চেষ্টা করছেন। হ্যাঁ, আপাতত বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনে এই আলোচনাকে আরও কিছুদিন জিইয়ে রাখার ব্যবস্থা করলেন বটে, কিন্তু যতক্ষণ না লড়াইটা রাজপথে নামিয়ে নিয়ে আসা যাচ্ছে, ততক্ষণ প্রধানমন্ত্রী মৌনতা দিয়েই এই সমস্যার সঙ্গে লড়ে যাবেন। তিনি দেশের মানুষকে বোকা ভাবেন।