এই যে দাদা, নাটক ফাটক না করে হনুমানের পুজো করুন, মিছিমিছি এসব নাটক করে লোক খ্যাপাচ্ছেন কেন বলুন তো? আমরা শান্তিতে থাকতে চাই, শান্তি আছে, চারদিকেই তো শান্তি। এবার মাঝেমধ্যে দু’ একটা দুষ্টু ছেলে, সোনা সোনা মন্টা ছেলে একটু কী ওই ধর্ষণ টর্ষণ করে ফেলেছে বলে তা নিয়ে কোবতে করতে হবে? নাটক করতে হবে? পরশু দিন নদিয়ার রানাঘাটের বাড়িতে কি তৃণমূলের কর্মীরা এই ভাষায় হুমকি দিয়েছিল নাট্যকার পরিচালক নিরুপম ভট্টাচার্যকে? জানি না, তবে এর থেকে আলাদা কিছু না বলে ধমকানো, শাসানো যায় কি? এটাই কি ক্ষমতার ভাষা নয়? আজ সেটাই বিষয় আজকের।
সেই যে সেই পরিবর্তন, তার আগে আমরা দেখেছিলাম শাঁওলি অর্পিতার পশুখামার নাটক বন্ধ করে দিতে, করেছিল সেই সময়ের সিপিএম নেতারা। ওসব পশু ফশু বলে লোক খ্যাপাবেন না, আমরা জানি সেই জমানাতেই উইঙ্কল টুইঙ্কল-এর শো বন্ধ করা হয়েছিল। আমরা জানি সে সময়ে রাজ্য সরকারের বদান্যতা পেতেন তথাকথিত গলা ভারী, বাম নাট্য ব্যক্তিত্বরা, সেসব নাটুকেপনা আমরা দেখেছি, এবং তখনও জানতাম এ বাম বা দক্ষিণ নয় আসলে ক্ষমতার ভাষা। ঠিক সেই ক্ষমতার ভাষাই উচ্চারিত হল মাঝরাতে নদিয়ার রানাঘাটে। রানাঘাট থেকে ১৬৪০ কিলোমিটার দূরে রাজ মুঙ্গাসে গাইছিলেন চোর আলে পঁচাশ খোকে ঘুন কিতি বাগা, চোর আলে একদম ওকে হুঁ। বাংলা মানে হল, দেখো চোরেরা ফিরে এসেছে ৫০ কোটি নিয়ে, দেখো চোরেরা ভালো আছে। কোথাও কারওর নাম নেই, কোথাও কোনও দলের নাম নেই কিন্তু পুলিশ তো জানে, প্রশাসন তো জানে মহারাষ্ট্রে কারা ৫০ কোটি নিয়েছে, কাজেই তিনি এখন হাজতে। কিছুটা দূরে মুম্বই, সেখানে উমেশ খাড়ে গেয়েছে ভোঙ্গালি কেলি জনতা। ভোঙ্গালি মানে হল নগ্ন, জনতার কাপড়ও জুটছে না, তাঁরা অনাহারে, বিরোধী আর শাসকদল মিলে কী সুন্দর সংসার চালাচ্ছে। এই হল গানের মানে, ব্যস, তিনিও জেলে। ক্ষমতার ভাষা। ওদিকে যোগী সরকার কিছুদিন আগেই লোকগায়িকা নেহা রাঠোরের ঘরে নোটিস পাঠিয়েছেন, যিনি গেয়েছিলেন ইউপি মে কা বা।
আরও পড়ুন: Aajke | তৃণমূল, জাতীয় তকমা ভ্যানিস
দুনিয়ার সর্বত্র গায়ক, লেখক, কবি, নাট্যকারদের ক্ষমতা ভয় পায়, তাদের ওপরে আঘাত আসে, তাদের ওপরে আঘাত আসলেই বোঝা যায় শাসক ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। হয় রাজার দরবারে বসে রাজার প্রশস্তি গাও নাহলে রাজার কারাগারে দিন কাটাও। ক্ষমতা, বিরোধিতা সহ্য করতে পারে না, সে বিরোধিতা আবার কবিতায়, গানে নাটকে এসে হাজির হলে শাসকেরা কড়া নাড়ে মাঝরাতে তারপর প্রথমে কড়কে দেওয়া, তারপর মারধর, তারপর খুন লোপাট করে দেওয়ার ইতিহাস আমাদের জানা। সেই কবেই পল রবসন শুনেছি, শুনেছি ওল্ড ম্যান রিভার, জো হিল-এর সেই গান কাল রাতে তোমায় স্বপ্নে দেখেছি জো হিল। নাজিম হিকমত লিখেছিলেন, ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না, নিগ্রো ভাই আমার পল রবসন। তেমনই এক ছোট্ট নাটক অনুষ্ঠিত হল নদিয়ার রানাঘাটে। নাট্যকার পরিচালক নিরুপম ভট্টাচার্য যিনি ভারাভারা রাওয়ের কবিতা কসাই-এর নাট্য রূপান্তর করেছিলেন, হাথরস থেকে হাঁসখালির ধর্ষিতাদের নিয়ে নাটক লিখেছিলেন, তাঁর বাড়িতে। জানেন মুখ্যমন্ত্রী? জানেন বা জানেন না সম্ভবত। জানেন বাকি তাবড় তাবড় দলনেতারা? সম্ভবত জানেন, কিংবা জানেন না, কিন্তু আশা করব এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু ক্ষমতার এই ভাষা? তা কি রোধ করা যায়? যাবে? কী বলছেন মানুষজন?
ক্ষমতার ভাষা কোথা থেকে জন্ম নেয়? তার জন্ম হয় আসলে দুর্নীতি থেকে, ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয়, ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারের জন্ম দেয় আর সেই দুর্নীতিকে ঢাকতে, স্বেচ্ছাচারকে ঢাকতেই ক্ষমতার এক ভাষা তৈরি হয়ে যায়। আর সেই ভাষার সবথেকে প্রথম প্রয়োগ হয় যে কোনও সৃষ্টিশীল মাধ্যমে প্রতিবাদের বিরুদ্ধে, তাদের নাপসন্দ গান কবিতা, নাটক, গায়ক, নাট্যকার, কবি, অভিনেতাদের ক্ষমতা সবসময়েই সফট টার্গেট ভাবে। কথায় কথায় রগড়ে দেওয়ার কথা বলে। তাই যুগে যুগে ক্ষমতার লালচোখ দেখেছে তারা। ‘পথের দাবী’ ব্যান করা হয়েছে, করেছে সুসভ্য ইংরেজরা, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট ব্যান করেছে হিটলার, নাৎসিরা। নীল দর্পণ নাটক বন্ধ করেছিল ইংরেজরা, উৎপল দত্তের কল্লোল নাটকের শো বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল কংগ্রেসি সরকার। বাম জমানায় পশুখামার বন্ধ করা হয়েছে আর বর্তমান তৃণমূল জমানায় এই নিয়ে বারতিনেক ঘটে গেল নাটক আর নাট্যকারদের ওপর আক্রমণ।
থাক এ কথা। একটা গল্প দিয়েই শেষ করি, ‘সিনেমার মতো’ নামে এক নাটকের প্রেস শো ছিল। সেখানে নাটকের এক চরিত্র প্রতিবাদ করতে থাকা অন্য এক চরিত্রকে হঠাৎই বলেছিল, অ্যাই ভাই, তুই কি তিনোমুলি নাকি রে? প্রেস শোতেও হাততালি পড়েছিল। পরে অবশ্য সে নাটকের ওই ডায়ালগ তুলে নেওয়া হয়েছিল। জানিয়ে রাখি, নাট্যকারের নাম, তিনি আজকের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এক অসম্ভব শক্তিশালী নাট্যকার ব্রাত্য নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন ক্ষমতার স্বর, ক্ষমতার ভাষা কাকে বলে।