ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসা, না অতটা নয় কিন্তু বামেরা যে রাস্তায় ফিরেছে তা স্পষ্ট। মাত্র ক’দিনের হিসেব দিই। ২৮ মার্চ সোমবার চুঁচুড়াতে জনসভা, বহুদিন পরে বামেদের সভায় নতুন মুখ, নতুন উদ্দীপনা। ৩ এপিল হাওড়ায় শান্তি মিছিলে পুলিশ, উত্তেজনা, সেলিমের নেতৃত্বে রাস্তায় মারমুখী মেজাজে দেখা গেল সিপিএম কর্মীদের। এর পরের দিনই বারাসতে আবার জমায়েত, ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল এগোল, আবার সেই একই ছবি উত্তেজনা এবং মিডিয়ার কভারেজ। এবং আজ উত্তরকন্যা অভিযান। বিরাট জমায়েত না, কিন্তু স্পিরিটেড জমায়েত, উদ্দীপ্ত যৌবন রাস্তায়। নাছোড় মীনাক্ষীকে দেখা গেল নেতৃত্বে। এসব জমায়েতে, মিছিলে ইস্যু অনেক আছে, কিন্তু চর্চা এবং মূল বিষয় দুর্নীতি। আছেন সেলিম, বিমান বসুও আছেন, কিন্তু চোখে পড়ার মতো ছাত্র যুবক যুবতীর ভিড়, সেটাই কোথাও কি অন্য কোনও বার্তা আনছে? আজ সেই বামেদের মিছিল আর অবরোধ ভাঙা, বামেদের রাস্তায় নামাই বিষয় ‘আজকে’।
হ্যাঁ, শূন্য হয়ে গিয়েছিল এ বাংলার অনেক রাজনৈতিক পণ্ডিতদের অবাক করে দিয়ে। শূন্য সিপিএম? বহুক্ষণ এই খবর বার বার করে ক্রস-চেক করেছি আমরাও। যে দল ক’দিন আগে ৩৪ বছর শাসন করেছে, তারা শূন্য, এবং তার বহু আগেই আগেই গড়িয়াহাটে, রাসবিহারীতে যে অটোর মাথায় লাল পতাকা ঝুলত, সেই অটোর মাথায় ঘাসফুল পতপত করে উড়েছে। এখন শূন্য হওয়ার পরে, বহু পার্টি অফিস যেখানে হাজিরা না দিলে ভাড়াতে তোলাও যেত না, বসানোও যেত না, সেখানে তালা পড়ল, বহু নেতা শারীরিক কারণে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করলেন, কিছু নেতা অনায়াসে দলবদলও করলেন। এসব দেখে মানুষজন ভেবেছিল শেষ হল বুঝি এক অধ্যায়। তারপরেও মীনাক্ষী, ঐশী, দীপ্সিতা, মধুজা, সৃজনেরা রাস্তায়, ক্লান্ত সূর্যের পশ্চিমে ঢলে পড়ার পরেই সেলিমের হাল ধরা। ৮০ পার কিন্তু এখনও কাঁধে গামছা নিয়ে কিশোর যুবকদের সঙ্গে রাস্তায় বিমান বসু। জায়গায় জায়গায় তারা জমায়েত করছে, মিছিল করছে, ব্যারিকেড ভাঙছে, হাজতে গিয়ে গণসঙ্গীত গাইছে। সব মিলিয়ে কি কাম ব্যাক?
আরও পড়ুন: Aajke | তৃণমূল জমানায় নাটক না করে হনুমান পুজো করুন
আসলে উল্টোদিকে দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ তৃণমূল, তাদের বিভিন্ন বড় সেজ মেজ ছোট নেতার বিরুদ্ধে মামলা, বাড়ি থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উদ্ধার হচ্ছে, আর সেই দুর্নীতিই কি বিরাট ইস্যু হয়ে উঠছে বামেদের কাছে? সেই ইস্যুতেই কি তাদের কাছে ভিড়ছে ছাত্র যুবকেরা? অন্যদিকে বিজেপি? তাদের ভরসা রাজ্যপাল, ইডি, সিবিআই, সংগঠন কোথায়? ধনখড়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা শুভেন্দু অধিকারী তো পারলে বর্তমান রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়েন। কাজেই তাদের রাস্তায় অনুপস্থিতিই কি বামেদের এক্সট্রা অক্সিজেন জোগাচ্ছে? শুভেন্দু, সুকান্তদের ভরসা তো দিল্লি, কিন্তু দিল্লি তো হাতে লাড্ডু ধরিয়ে দিয়ে যাবে না। সেই জন্যই মানুষের ক্ষোভ কি এসে ঠেকছে বামেদের উঠোনে, তৃণমূল বিরোধী মানুষজনের ভরসা কি তাহলে বামেরা? সত্যি কি তারা শক্তি বাড়াচ্ছে?
সংসদীয় গণতন্ত্রে এক শূন্য পাওয়া দল কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে? শূন্য থেকে শুরু? কতটা এগোতে পারে? সারা পৃথিবীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ যখন লাল, বামেদের দখলে, তখন এদেশের ছাত্র যুবকেরা প্রেরণা পেয়েছে অস্ত্রভিস্কির ইস্পাত পড়ে, শোলোকভের কুমারী মাটির ঘুম ভাঙছে পড়ে বা চিং চিং মাই-এর বিপ্লবের গান তাকে উদ্দীপ্ত করেছে। বেরেট টুপি মাথায় সিগার মুখে চে ছিল সেদিন। আজ? টিম টিম করে কিউবা আর ভিয়েতনাম, চীন নিয়ে বিস্তর ধোঁয়াশা, এমন এক সময়ে এই কিশোর যুবকেরা এখনও রাস্তায় নামছেন, এটাও তো বড় খবর। কী বলছেন মানুষজন?
বেশ খানিকটা শক্তি নিয়ে কিছু জায়গায় কেন্দ্রীয় মিছিল জমায়েত তো করা যায়, কিন্তু পাড়ায় এসে প্রতিদিনের রাজনীতিতে নামার মতো অবস্থা কি সিপিএম-এর হয়েছে? গ্রামে, মহল্লায়, শহরে, বস্তিতে সিপিএম হাজির এমনটাও কি দেখছি আমরা? না দেখছি না, কিন্তু মধ্যের যে বিচ্ছিন্নতা তা কেটেছে, বামেরা দৃশ্যমান, তাদের দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তুলনা তো উঠবেই? আজকে যে হাতে গরম দুর্নীতির ইস্যু মানুষের সামনে আছে, একবার কল্পনা করুন সে ইস্যু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে, সে ইস্যু বাম জমানার? আন্দোলনের কোন পর্যায় আমরা দেখতাম? স্তব্ধ হয়ে যেত না শহর বন্দর মাঠ পাথার? পুলিশের ঘুম ছুটে যেত না? জেল উপচে পড়ত না? তেমনটা হচ্ছে না কেন? কারণ বামেদের সেই বিশ্বাসযোগ্যতা এখনও ফিরে আসেনি, তাদের নেতৃত্বের সেই বিশ্বাসযোগ্য মুখের বড্ড অভাব। দু’ নম্বর সমস্যা হল বামেদের দেশজোড়া রাজনীতি, কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই, এ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট, কদিন আগে বিজেপি সখা নীতীশ কুমারের সঙ্গে জোট, এ রাজ্যে মমতার সঙ্গে লড়াই, সব মিলিয়ে এক হযবরল অবস্থান, আর সে অবস্থান নিয়ে মানুষের তো প্রশ্ন আছেই। দলের মধ্যেও কি নেই? আছে। সেই সংশয় কাটিয়ে এক পরিষ্কার রাজনীতি নিয়ে মানুষের কাছে না গেলে গ্রহণযোগ্যতা না বাড়লে কেবল রাস্তায় থেকে রেজারেকশন, পুনরুত্থান সম্ভব নয়। তবুও প্রথম ধাপ পেরিয়ে বামেরা পথে, বামেরা মানুষের কাছে তাই বা কম কী?