দাঁড়ে বসে থাকা তোতাপাখি কত রগড় দেখায়। কেউ সাতসকালে উঠে হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ বলে কেউ বা সীতারাম সীতারাম। তোতাকে চা বিস্কুট খেতে দেখেছি, দাঁড়ে বসে ডিগবাজি খেতে দেখেছি। আমার ঠাকুমার তোতা কাউকে দেখলেই বলত, আ মরণ, ঢং দেখো একবার। শিখেছিল কার থেকে বলার নিশ্চয়ই দরকার নেই। তো সে হেন তোতাপাখির নাম জুড়ে গিয়েছে সিবিআই-এর সঙ্গে। না আমি জুড়িনি, জুড়েছে মহামান্য উচ্চ নয় সর্বোচ্চ আদালত। এ হল সেই দাঁড়ে বসা পাখি যে মালিক বা মালকিনের ভাষায় কথা বলে, যার নিজের না আছে কোনও বোধ, না আছে বুদ্ধি। সাতসকালে সিবিআই কর্তারা দৌড়চ্ছেন, সকালের দরকারি কাজকর্মও সারা হয়নি অনেকের। কিন্তু হুকুম এসেছে, কেবল কি হুকুম, হুকুমের সঙ্গে ফাটাফাটি ইনফর্মেশন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে সরকারি কাগজ ডাঁই করে পোড়ানো হচ্ছে। আর সরকারি কাগজ মানেই তো হল ওএমআর শিট, কিংবা নিয়োগ দুর্নীতির তালিকা, কাকে কে কত টাকা দিয়েছে, কে কত নিয়েছে তার হিসেব নিকেশ। সে সব নাকি মাঠে এনে আগুন লাগানো হয়েছে। অতএব সিবিআই দৌড়চ্ছে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন। অতএব তারা অকুস্থলে হাজির। শেষে দেখা গেল, বিহারের কিছু পুরনো বাতিল দস্তাবেজ, পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। সিবিআই বাড়ি ফিরিলেন। এমন কি কেবল একটা ঘটনা? রোজ ঘটে চলেছে কিছু না কিছু, আমাদের মানে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ। আজ সেটাই বিষয় আজকে।
সর্বত্র সিবিআই। খুন, জখম, ধর্ষণ, ইলোপ থেকে কিডন্যাপ, একই দাওয়াই, সর্বরোগহর ওষুধ, সিবিআই কো বুলাও। আদালতের রায়ে, নিজেদের থেকে, সরকারের আদেশে সিবিআই মামলার পর মামলাতে জুড়ে যাচ্ছে, জোড়ানো হচ্ছে। নেট রেজাল্ট? তুমি কি কেবলই ছবি? শুধু পটে লেখা? হ্যাঁ, রবিঠাকুরও তাই ভাবছেন নিশ্চয়ই, ওনার নোবেল মেডেল উদ্ধার করার দায়িত্ব তো সিবিআই-এর হাতেই ছিল, ওনারা দায়িত্ব নেওয়ার পরে সে নোবেল চুরি নিয়ে ছবি করে ফেললেন মিঠুন চক্কোত্তি, কিন্তু নোবেল এখনও ফেরেনি। হ্যাটা কি একটা? এই সেদিন ২৮ মার্চ, জনসভায় দাঁড়িয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে, জোর করে আমার নাম বলানোর চেষ্টা চলছে। এসব শুনেই বিচারক বললেন তাহলে দুজনকে বসিয়ে জেরা করা হোক। বলার আগেই নোটিস চলে গেল অভিষেকের কাছে, এবং তারপর সিবিআই জানল যে তার আগেই সর্বোচ্চ আদালত এ বিষয়ে আগেই স্থগিতাদেশ জারি করেছে।
আরও পড়ুন: Aajke | ও জীবন ছাড়িয়া যাস নে মোরে
এতটা অপদার্থ একটা সরকারি দফতর, এরা নাকি সত্য বের করে আনবে? কেবলমাত্র বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার জন্য পেয়াদাগিরি করা ছাড়া কি এদের কি কোনও কাজ নেই? বিবিসি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে, দফতরে চলে গেল ইনকাম ট্যাক্স। কলকাতা টিভি বিরোধিতা করছে, চলে এল সিবিআই। ভয় দেখিয়ে জেলে পুরে কাঁহাতক সত্যিটাকে আড়াল করা যায়? কতদিন মানুষের কণ্ঠস্বর রোধ করে রাখা যায়? দেশের সরকারের হাতে সংবিধান প্রণেতারা কিছু ব্যবস্থা তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন, পুলিশি ব্যবস্থা, শান্তি রক্ষার জন্য, দেশ জুড়ে বড় ষড়যন্ত্র আটকাতে। আর্থিক অপরাধ আটকাতে সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, এনআইএ। কিন্তু আজ? এসব ব্যবহার হচ্ছে বিরোধীদের আটকানোর জন্য, প্রতিবাদীদের চুপ করানোর জন্য। এবং তার সঙ্গে লাগাতার বিভিন্ন মামলাতে ব্যর্থতা সিবিআইকে মানুষের কাছে হাস্যাস্পদ করে তুলেছে।
মাঠে একটা কঞ্চির ডগায় একটা হাঁড়ি বেধে, ভুসো কালি দিয়ে চোখ মুখ এঁকে পাখিদের ভয় তো দেখানোই যায়। কিন্তু মানুষ তো পাখি নয়, কতদিন সিবিআই-এর জুজু দেখিয়ে ভয় দেখানো জারি থাকবে? আর সবথেকে ভয়ের কথা হল, এটাই যদি নিয়ম হয়ে যায়? যদি যে আসে সরকারে, সেই যদি তার বিরোধী মত, বিরোধী স্বরকে স্তব্ধ করার জন্য এই সিবিআই ভিজিলেন্স, ইডি, পুলিশকে ব্যবহার করতে থাকে, তাহলে তো দেশে আইন বলে আর কিছু থাকবেই না। আজ যে তৎপরতা দেখিয়ে সাতসকালে পোড়া কাগজ উদ্ধার করতে গেলেন সিবিআই কর্তারা, তাঁরা এই তৎপরতার অর্ধেক দেখালেও আজ ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে কেটে পড়নেওয়ালাদের, ওই নীরব মোদি, মেহুল চোকসি থেকে দেশের টাকা লুঠ করনেওলাদের আটকানো যেত। এদেশের আম নাগরিকের ট্যাক্সের পয়সায় যাদের মাইনে হয়, এদেশের মাটি জল আর বাতাস নিয়েই যারা বেঁচে থাকেন, তাঁদের ঘরে স্ত্রী সন্তান, বাবা মা নেই? ভাই দিদি বোন নেই? তাদের দিকে তাকান আর মনে মনে ভাবুন, এই তোতা পাখি হয়ে কতদিন কাটাবেন? আর কতদিন?