চারটে পা নিয়ে মোদিজির বিজেপি রওনা দিয়েছিল ২০১৪তে। প্রথম পা ছিলেন সেদিনের গুজরাতে হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরিতে সফল এক্সপেরিমেন্ট করে আসা নরেন্দ্র মোদি, তিনি এবার দেশের হিন্দু হৃদয়সম্রাট হতে চান। দু’ নম্বর ছিল বিকাশ উন্নয়ন, সবকা সাথ সবকা বিকাশ, কালা ধন ওয়াপস লায়েঙ্গে ইত্যাদি। তিন নম্বর পা ছিল দেশে বাড়তে থাকা সুর্নীতি, বংশবাদ বা পরিবারবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি আর চার নম্বর পা হল মিয়া মুশারফ, ঘরমে ঘুস কর মারেঙ্গে, এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদ। এই চার পা নিয়ে ২০১৪তে মোদিজির যাত্রা শুরু। মোদিজির বিকাশ মডেলের পরীক্ষা শুরু হল সেই তখন থেকে। বিশ্বের অর্থনীতিবিদেরা বলেন, মানুষের রোজগার বাড়াতে হবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে চাহিদা বাড়বে, বাজারে চাহিদা বাড়লে তার জোগানের জন্য শিল্প বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে, যার ফলে রোজগারের পথ খুলে যাবে, চাকরি বাড়বে, চাকরি বাড়া মানেই আবার মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে যাওয়া। এটাই দুনিয়ার অর্থনীতিবিদরা বলেন, অন্তত কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা এই নীতিকেই মেনে চলে। এই বাজারের বাড়তে থাকা আয়ের এক অংশ যায় সরকারের কাছে, সরকার তা ইনফ্রাস্ট্রাকচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল ইত্যাদির জন্য খরচ করবে, গরিষ্ঠাংশ তলার সারির মানুষজন অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ হলেই দেশের মোট অর্থনীতি বাড়বে। কিন্তু না, মোদিজির বিকাশ বা উন্নয়নের মডেল এটা নয়। ওঁর মডেলটা ওপর থেকে নীচে চুঁইয়ে পড়ার মডেল। উনি চান দেশে কয়েকজন বিশাল সম্পদশালী হয়ে উঠুন, তাঁদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য সরকারও সাহায্য করবে, তাদের সম্পদ বৃদ্ধি হওয়া মানে দেশের মোট সম্পদ বেড়ে ওঠা, ওই যে পঞ্চম অর্থনীতি, তৃতীয় অর্থনীতি, ফাইভ ট্রিলিয়ন অর্থনীতি ইত্যাদির গল্প। এবং একটা বিরাট অর্থনীতি তৈরি হলে তার যে অংশটা চুঁইয়ে পড়বে, সেটাই তলার সারির লোকেদের বাঁচিয়ে রাখবে। তাতেও যদি অসুবিধে হয় তাহলে তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্র সারা মাসে ১৫ কেজি চাল, ডাল, গমের ব্যবস্থা করবে, ব্যস। এটাই ওঁর অর্থনৈতিক মডেল। কাজেই পার ক্যাপিটা ইনকাম বাড়বে, বাড়বে দেশের জিডিপি এই তত্ত্ব নয়, ওঁর লক্ষ জিডিপি বাড়বে, মোট অর্থনীতি ৫ ট্রিলিয়ন হবে, দেশ দুনিয়ার পঞ্চম বৃহত্তর অর্থনীতি হবে কিন্তু পার ক্যাপিটা ইনকাম, মাথা পিছু রোজগারে দেশ থাকবে ১২৮ নম্বরে।
দেশের ১ শতাংশ মানুষের কাছে রয়েছে দেশের ৪০.৫ শতাংশ সম্পদ, দেশের ১০ শতাংশের কাছে রয়েছে দেশের ৭২ শতাংশ সম্পদ, ৯০ শতাংশের কাছে ২৮ শতাংশ সম্পদ। সেটাও তলার ৫০ শতাংশের হিসেব ধরলে, সেই ৫০ শতাংশের কাছে দেশের ১ শতাংশ সম্পদ আছে। ওদিকে সরকারের হিসেবে বেকারত্ব এই সময়ে ৭.৭ ছুঁইয়েছে, কিন্তু এতে জল দেওয়া আছে প্রচুর। আন্ডার এমপ্লয়মেন্টের হিসেব নেই, যে লোকটা বাদাম বেচে, প্যাকেজড ড্রিঙ্কিং ওয়াটার বেচে, মুটে বা কখনও সখনও দিনমজুরের কাজ পায়, তাদের হিসেব এর মধ্যে নেই। এর মধ্যে নেই সিজনাল এমপ্লয়মেন্টের কথা, ধান রোওয়ার সিজনে কাজ আছে তারপর বসে থাকা এবং এসবের হিসেব মেলালে এই হিসেব ২৫ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে, সালানা দেড় করোর কি রোজগার এক নির্ভেজাল বাওয়াল, তা প্রমাণিত। কাজেই ওই বিকাশের ঢক্কানিনাদ আছে, প্রকৃত বিকাশ যাকে স্পর্শ করা যায়, তা হয়নি। চার পায়ের এক পা গেল। এরপর দুর্নীতির তত্ত্ব। হ্যাঁ, মোদিজি তাঁর ইডি আর সিবিআই-এর অভিযান দিয়ে যে ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন, তা মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছিল বইকী। কিন্তু মানুষ দেখল, সেই ইডি, সিবিআই, ভিজিলেন্স, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদির অভিযান ধীরে ধীরে কেবল বিরোধীদের দিকেই ছুটছে। একজনও শাসকদলের নেতারা সেই অভিযানের তালিকাতেই নেই, কেবল তাই নয়, ইডি, সিবিআই-এর অভিযানে অভিযুক্ত বিরোধী নেতারা বিজেপিতে যোগ দিলেই ওয়াশিং পাউডার নিরমা, হিমন্ত বিশ্বশর্মা, অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজবলের দিকে তাকালেই সেটা মানুষ বুঝতে পারছে। দলের সভা থেকেই যে দলকে ৭০ হাজার কোটি টাকা স্ক্যামের সঙ্গে জড়িত বলে জানালেন, তাদের নেতাদের তারপরের দিনেই বুকে টেনে নিলেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজি ভাবছেন, মণিপুরের কথা দেশের মানুষ ভুলে যাবেন
এই মুহূর্তে প্রায় প্রতিটা বড় বিজেপি নেতার ছেলেমেয়েরা রাজনীতিতে, বড় পদে, আর্থিকভাবে লাভবান পদে, এমএলএ, এম পি হয়ে বসে আছে, পরিবারবাদের কথাবার্তাও তেমন ধোপে টিকছে না এবং আদানি এপিসোডে মিঃ ক্লিন মোদিজির গায়েও কালি লেগেছে। অতবড় দুর্নীতির অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তিনি একবারও আদানির নাম নেওয়ার সাহস দেখাননি, এমনকী আইন আইনের পথে চলবে সেটাও বলার সাহস পাননি। দেশ দেখছে কীভাবে হাতে গোনা কয়েকজনের জন্য দেশের সরকার অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছে। একটা ছোট উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। কিছুদিন আগেই মুকেশ আম্বানি জানিয়েছিলেন যে জিও বুক আসছে বাজারে, কম দামে। ভালো। মাত্র দু’ দিন আগে সরকার বিদেশ থেকে যে যে ল্যাপটপ কোম্পানিরা তাদের প্রডাক্ট এখানে পাঠাত, ডেল, এইচ পি, লেনোভো ইত্যাদি প্রত্যেক আমদানির ওপর কড়া বাধানিষেধ চাপিয়ে দিল, মানে আম্বানির ব্যবসা বাড়ুক। বদলে আম্বানি কী দেবেন? সব্বাই জানে কর্পোরেট ডোনেশনের ৮০ শতাংশ পাচ্ছে বিজেপি, ঘুরপথে আর কী কী পাচ্ছে জানা নেই এবং এই আম্বানি আদানিদের মালিকানায় মিডিয়ার দু’ হাত তুলে সমর্থন তো আছেই। কাজেই ওই দুর্নীতি, পরিবারবাদ ইত্যাদির স্লোগান যে নির্ভেজাল বাওয়াল তা পরিষ্কার। তিন নম্বর পায়ের কথায় আসি, জঙ্গি জাতীয়তাবাদ, জিঙ্গোইজম। জঙ্গি জাতীয়তাবাদের জন্য দরকার সীমান্তে উন্মাদনা, সামরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দিক থেকে পাকিস্তান ধুঁকছে, মরার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে দেশপ্রেমের বন্যা বওয়ানো যায় না। তাহলে বাকি রইল বিশাল সীমান্ত জুড়ে চীন, যেখানে সত্যিই চীনা ফৌজের আনাগোনা বাড়ছে, রাস্তাঘাট, এয়ারপোর্ট তৈরি হচ্ছে, সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সেখানে সমস্যা হল চীনকে ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে বলার মতো বোকা নরেন্দ্র মোদি নন। ওঁর ছাতির মাপ ৫৬ ইঞ্চি বলে যে বাওয়াল উনি দেন, তা ভিত্তিহীন। এবং সারা পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে আমাদের পরধান সেভক অ্যাত্তো শান্তি আর উন্নয়নের কথা বলেছেন যে এখন সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হলেও তাঁর দিকে আঙুল উঠবে। কাজেই তিন নম্বর পায়াও নড়বড়ে হয়ে গেছে। বাকি রইল হিন্দুত্ব, হিন্দু হৃদয়সম্রাট।
হ্যাঁ, এখানে এখনও যথেষ্ট স্কোপ আছে, এটা মোদি-শাহ জানেন। মণিপুর থেকে হরিয়ানার আগুন এই বড় পরিকল্পনার অঙ্গ। মণিপুরের আগুন নিভছে না এখনও, বরং তা ছড়াচ্ছে মিজোরাম, উত্তর অসম, মেঘালয়ে। গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলে ট্রাইবাল, নন ট্রাইবাল বাইনারি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিজেপির দাঙ্গা চাই সমতলেও। খেয়াল করে দেখুন দক্ষিণে বিজেপির দরজা বন্ধ। লিখে নিন তেলঙ্গানাতে বিজেপি তিন নম্বরে থাকবে। অন্ধ্রে বিজেপি একটা আসন পাবে? একজন এমপি? না। পূর্বদিকে ওড়িশা, বাংলা, ঝাড়খণ্ড, বিহারে বিজেপি যেটুকু ছিল তার থেকে কমবে। কাজেই উত্তর আর পশ্চিম ভারতে হিন্দুত্বকেই আঁকড়ে ধরেছে বিজেপি। আরএসএস-এর অর্গানাইজারে লেখা হচ্ছে, কেবল হিন্দুত্ব বা নরেন্দ্র মোদির ওপরে ভরসা করে থাকলে চলবে না, দলের এমপিদের ডেকে মোদিজিও ঠিক এই কথাই বলছেন, কিন্তু কাজে? কাজে এক্কেবারে অন্যরকম। খুঁড়ে বার করার চেষ্টা হচ্ছে জ্ঞানবাপী মসজিদের ইতিহাস, উসকে দেওয়া হচ্ছে সেই স্লোগানকে, ইয়ে তো পহেলি ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়। মসজিদের মধ্যে শিবলিঙ্গ আর ত্রিশূল খুঁজে পাওয়ার গল্প হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে ভাইরাল। সেখানে মহিলারা পুজোর অনুমতি চাইছেন, এঁরা দুর্গাবাহিনীর সদস্য। হরিয়ানাতে আগুন। হরিয়ানা আর পঞ্জাব, পার্টিসানের পরে দেশ বিভাজনের পরে আমাদের পশ্চিম দিকের মুসলমান জনগণ প্রায় পুরোটাই ফিরে গেছেন পাকিস্তানে, আর ওপার থেকেও প্রায় পুরো হিন্দু জনসংখ্যা যেভাবেই হোক চলে এসেছে এদেশে। পূর্বে তা হয়নি, এ বাংলা, অসমে তা হয়নি। পঞ্জাব, হরিয়ানাতে হয়েছে, পঞ্জাবে মুসলমান জনসংখ্যা ৩ শতাংশের কম, হরিয়ানাতে ২ শতাংশ মুসলমান। কিন্তু দু’ রাজ্যেই একটা করে অঞ্চল বা জেলা আছে যেখানে এক বিরাট সংখ্যক মুসলমান আছেন, তাঁরা বিভাজনের সময়ে এদেশেই থেকে গেছেন। অবশ্য দুটো ভিন্ন কারণে। পঞ্জাবে মালেরকোটলা জেলা বা অঞ্চলে মুসলমানেরা পাকিস্তানে যাননি কারণ সেখানে শিখেরা তাঁদের রক্ষা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। এই মালেরকোটলার মুসলমান নবাব গুরু গোবিন্দ সিংয়ের দুই সন্তানকে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, তাই শিখ বা পঞ্জাবি মানুষজন এই মালেরকোটলাতে দেশ বিভাজনের সময়ে কোনও ঝামেলায় জড়াননি। আজও এখানের এমএলএ সংখ্যালঘু ধর্মের, আজও এখানে একটা উত্তেজনার চিহ্ন নেই। অন্যদিকে হরিয়ানার মেবাত অঞ্চলের মুসলমানেরা পাকিস্তানে যাননি কারণ তাঁরা মনে করেছিলেন এদেশেই তাঁদের স্বার্থ সুরক্ষিত। আজ এতদিন পরে সেই মেবাত অঞ্চলের ন্যু জেলাতে হিন্দুত্ববাদীরা আক্রমণ চালাচ্ছে, ঘরে আগুন দিচ্ছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়াচ্ছে। আগেই বলেছি হরিয়ানাতে মাত্র ২ শতাংশ মানুষ মুসলমান, কিন্তু এই ন্যু জেলাতে ৭৫-৭৬ শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু। তার মানে গোটা হরিয়ানার মুসলমানেরদের বেশিরভাগটাই এই ন্যু-তে থাকেন। কাজেই এখানে দাঙ্গা লাগানো সহজ, আর দাঙ্গা লাগানো হচ্ছে এটা বলে যে মুসলমানেরা সংখ্যাতে আমাদের চেয়েও বেড়ে গেছে, এই দাঙ্গার মূল লক্ষ্য আসলে এক ধর্মীয় মেরুকরণ। হ্যাঁ, আরএসএস–বিজেপির চোখ জানুয়ারিতে রামমন্দির উদ্বোধনের দিকে, বিরাট ইভেন্ট, সব খামতি ঢেকে হিন্দু হৃদয়সম্রাটের আরেক চেহারা হাজির করা হবে, কিন্তু সমস্যা হল চার চাকার গাড়ির তিন চাকা নেই, এক চাকা নিয়ে সে গাড়ি কতটা পথ পার করবে?