বাঙালির কাছে অকাল বোধন নতুন কিছু নয়, কাজেই বিজেপির এই অকাল বোধনে মানুষ অবাক হননি। কেবল ওই কেলোদা, ওই যে চায়ের দোকানের কেলোদা, হুট বলতে ঝুট কী সব যে বলে বসেন, তার মানে সব সময় বোঝাও যায় না। সেই কেলোদা বললেন, এত তাড়াতাড়ি ভায়া? দম রাখতে পারবে তো? কেলোদার অনেক কথা না বুঝলেও একথা জলের মতো পরিষ্কার, ২০২৩-এর এপ্রিল মাসে ২০২৪-এর মে মাসের যুদ্ধের মহড়া শুরু করলে ভায়া, শেষ করতে পারবে তো? হ্যাঁ, যদি আজকে বিজেপির সিউড়ি সমাবেশে চোখ রাখেন তাহলে মনেই হতে পারে, লোকসভা ভোট চলছে, তার প্রচারে এসেছেন বিজেপি নেতামন্ত্রীরা। তাই কেলোদার সহজ প্রশ্ন, এত আগে থেকে শুরু করলে দম ধরে রাখা যাবে তো? কিন্তু সেটাও আজ বিষয় নয়। বিষয় হল, ভারত মাতা কি জয়, যশস্বী, মঞ্চ পর অ্যা রহে হ্যায়, কারিয়াকর্তা, জন্তা জনার্দন, বুয়া ভাতিজা, জোর সে বোলিয়ে, বিরোধী পক্সকে নেতা। হ্যাঁ, সারাক্ষণ এক বিজাতীয় ভাষায় ভাষণ চলল। কেবল অমিত শাহ হলে তো বলার কিছুই ছিল না, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, রাজ্য সভাপতি, মঞ্চ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কারিয়াকর্তা আধা হিন্দি আধা বাংলাতে বলে গেলেন। আমাদের বলতে ইচ্ছে হল, রেখেছ বিজেপি করে মা গো বাঙালি করোনি। হ্যাঁ সেটাই বিষয় আজকে।
তখন সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর রমরমা বাজার, যাই বলেন, তাই খবর। সেরকম এক সময়ে একজন সিপিএম নেতার মৃত্যুর পরে ওনাকে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, সুভাষদা, আপনার দলের নেতারা সবাই গিয়ে হাত মুঠো করে লাল সেলাম জানালেন আপনি নমস্কার করলেন কেন? আপনি কি কমিউনিস্ট নন? উনি বলেছিলেন, খবর হয়েছিল। “বাঙালি মানুষজন নমস্কার বোঝে, ওই হাত উঠো করার সংস্কৃতি আমাদের নয়।” এক্কেবারে নাড়ি টিপে সত্যিটা সেদিন উনি বলেছিলেন, মানুষের মাঝখানে থেকে রাজনীতি করতে হলে, সে মানুষের ভাষা সংস্কৃতি তো বুঝতে হবে, বলতে হবে। যশস্বী? বাঙালি মাথা চুলকে বলতেই পারে যশ চোপরা? যশরাজ স্টুডিও? বাংলার মানুষ বসে আছেন, বিশেষ করে বীরভূমের মা বোনেরা, এক বিশুদ্ধ বাঙালি বিকৃত হিন্দি উচ্চারণে বলছেন, ‘দেশ কা স্বরাষ্ট্র মনতিরি অমিত শাহো জি কো সাগতম সাগতম।” কেন? হ্যাঁ বিজেপি তো চায় এক দেশ, এক নেতা, এক ধর্ম, এক ভাষা। কিন্তু মানুষ কি মেনে নেবে? যখন চিৎকার করে অমিত শাহজি বলছেন গো, তস্করিকে সাথ জুড়ে হুয়ে লোগো কো জেল মে রহনা চাহিয়ে কি নহি চাহিয়ে? বোলিয়ে চাহিয়ে কি নহি চাহিয়ে? সামনে বসে থাকা মহিলারা নির্বাক, উচ্ছ্বাসহীন।
আরও পড়ুন: Aajke | বামেরা রাস্তায়, তৃণমূল আদালতে, বিজেপি তাকিয়ে আছে মোদি–শাহের দিকে।
২০২৩-এ এই অকাল বোধন কেন? বিজেপি কি বুঝে গেছে কর্নাটক হাতের বাইরে যাচ্ছে? বিহার হাতের বাইরে? ওড়িশাতে বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না, জগন রেড্ডিকে খেপানো যাবে না, তাই এখন আপাতত টার্গেট এই বাংলা আর তেলঙ্গনা? খোলসা করলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। হায়দরাবাদে যশস্বী প্রধানমন্ত্রীজি যে মার্গদর্শন করিয়েছিলেন তার কথা বললেন, বললেন বাংলা আর তেলঙ্গনা জিততেই হবে। কিন্তু দু’ রাজ্যেই বিজেপির প্রধান সমস্যা বিজেপি হিন্দি, হিন্দি, হিন্দুস্থান পরিচিতি। অমিত শা তো মঞ্চেই বললেন ২০২৪-এ বাংলায় বিজেপি ৩৫টা আসন পেলে, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে মমতা দিদি, ঘরারারারা ফুস… হাসবেন না, এটা হিন্দিও নয়, উত্তেজনায় উনি গুজরাতে ফিরে গিয়েছিলেন। বাঙালিরা যেরকম ঘুড়ি কাটলে বলে, ভোঁ কাট্টা। গুজরাতিরা বলে ঘারারারার ফুস। অমিত শাহের ভাষণ ইত্যাদি ছেড়েই দিন, যে কোনও দিন রাজ্য বিজেপির কোনও প্রেস মিটে চলে যান, হিন্দি শব্দ এবং হিন্দি সংস্কৃতির ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন। উল্লাসের কোনও খবর এলেই এখনও বাংলা বিজেপির সদর দফতরে রসগোল্লা নয়, লাড্ডু আসে। আমি বলছি? আচ্ছা দেখাই যাক না, কী বলছেন মানুষজন? বিজেপিকে কি একটু বেশি অবাঙ্গালি দল বলেই মনে হয় না কি?
সম্ভবত অকাল বোধন বলেই এবারে সেই পাত পেড়ে খাবার নাটক অভিনীত হয়নি, কিন্তু যদি স্মৃতির ঝোলা হাতড়ান, তাহলে মনে পড়েই যাবে, অমিত শাহের পাতে আলু পোস্ত আর রুটি। ঠিক রুটি নয় চাপাটির সেই ছবি, যা দেখে বীরভূমবাসী এখনও হাসেন, ই মা গ, প্যোস্ত দ্যে রুটি? কী কর্যেন খেলেন বটে? শুধিয়েছিল এক বীরভূম রমণী। স্বাধীনতার পর থেকে দক্ষিণ বাদ দিলে একমাত্র বাংলা, যে রাজ্য তার সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে বুকের কাছে, তা নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়। কিন্তু বিধান রায়ের ধুতি, বুশ শার্ট, জ্যোতি বসুর নিপাট ধুতি পাঞ্জাবি পাম্প শু, গিলে করা পাঞ্জাবি, ধাক্কা পাড়ের ধুতিতে মানুদা, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, সাদা ধবধবে চুল আর আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধুতিতে বুদ্ধদেব আর নরুন পাড় শাড়ি, হাওয়াই চপ্পলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বাঙালি ঐতিহ্যকে এমনি এমনিই বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন না। বাংলার রাজনীতিকে বাংলার সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা ভারি মুশকিল, সেটা বিজেপির মাথায় ঢোকেনি। বাঙালি একলা রামের পুজো কখনওই করেনি, বাঙালি পুজো করেছে সীতা-রামের, রামকৃষ্ণের, চৈতন্যের। সেইখানেই বিজেপি এই বাংলাতে বাঙালি মানুষের কাছের জন হয়ে উঠতে পারছে না, সে বিজেপিই থেকে যাচ্ছে বাঙালি হয়ে উঠতে পারছে না।