কলকাতা: একই দিনে পদ্ম ফেরালেন তিন বাঙালি। তিনজনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিচিত। এ ঘটনা নজিরবিহীন তো বটেই, এমনকি ব্যতিক্রমীও। বিভিন্ন মহলে চর্চা চলছে, বাংলা এবং বাঙালি বলেই এভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে পদ্ম প্রত্যাখ্যান সম্ভব। এখানেই লুকিয়ে আছে বাঙালির অস্মিতা। সবিনয়ে পদ্ম ফেরানোর এই ঘটনা নিয়ে বাঙালি গর্ব করতেই পারে। এতে আবারও প্রমাণিত হল, বাংলা ও বাঙালির শিরদাঁড়া বিকিয়ে যায়নি।
কেন্দ্রীয় সরকার এবার পদ্মভূষণ দিতে চেয়েছিল সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। কেন্দ্রের পদ্মশ্রীপ্রাপকের তালিকায় ছিল গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং প্রবীণ তবলা শিল্পী পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের নামও। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির তরফে মঙ্গলবার তিনজনের কাছেই ফোন আসে। তিনজনই সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তা নিয়ে বুধবারও নানা মহলে চর্চা অব্যাহত।
আরও পড়ুন: Dhankhar Vs Mamata: রেড রোডে রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী দেখা হল, কথা হল না
কেন্দ্রীয় সরকার মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পদ্মপ্রাপকদের যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে বাংলা এবং বাঙালির নাম খুবই কম রযেছে। দশকের পর দশক ধরে কলকাতার বাসিন্দা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী রাশিদ খানকে পদ্মভূষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে আবার উত্তরপ্রদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে যাঁর সঙ্গে বাংলার কার্যত কোনও যোগাযোগ নেই, সেই প্রবীণ অভিনেতা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম রয়েছে বাংলার প্রতিনিধি বলে। ভিক্টরকেও এবার পদ্মভূষণ দেওয়া হয়েছে। এক সময় ভিক্টর লোকসভা ভোটে বিজেপির প্রার্থীও হয়েছিলেন।
অনেকে আবার এই পদ্ম-তালিকায় রাজনীতিরও গন্ধ পাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরিই বলে দিয়েছেন, ‘যা হয়েছে তাতে রাজনীতির রং স্পষ্ট। বাংলার আরও অনেক গুণীর কথা দিল্লির মনেও পড়ে না। তবে বাংলা কারও ভিক্ষা বা করুণা চায় না।’
মঙ্গলবার রাতেই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পদ্মভূষণ পুরস্কার নিয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকে কেউ কিছু বলেনি। যদি আমাকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আমি তা প্রত্যাখ্যান করছি।’ পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র জানান, এরকম বিষয়ে যোগাযোগ করতে হলে তাঁর বাড়ি কিংবা দলের দফতরের ঠিকানায় চিঠি পাঠাতে অনুরোধ করেছেন বুদ্ধবাবু। ফোন করার বা তাঁর সঙ্গে দেখা করার কোনও প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুন : Padma Vibhushan: মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ পাচ্ছেন সিডিএস বিপিন রাওয়াত
এর আগে প্রথম ইউপিএ জমানায় রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ভারতরত্ন দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল। ব্যক্তিগতভাবে জ্যোতিবাবু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। আপত্তি করা হয়েছিল দলের তরফেও। সিপিএম নীতিগতভাবে এধরনের রাষ্ট্রীয় উপাধি গ্রহণের বিরোধী। সুদূর অতীতে কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদও পুরস্কারের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
প্রায় সাত দশকের দীর্ঘ সঙ্গীত জীবন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। রাজ্য সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁকে পদ্মশ্রী নিতে হবে, এমনটা ভাবনারও অতীত সন্ধ্যা অনুরাগীদের। তিনিও পত্রপাঠ কেন্দ্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। একইভাবে পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রবীণ তবলা শিল্পী অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। দেশে-বিদেশে অনিন্দ্যও নানা পুরস্কার লিখেছেন। কলকাতা টিভি ডিজিটালকে তিনি বলেন, ‘আমার সমসাময়িক এবং জুনিয়র অনেক শিল্পী ইতিমধ্যেই পদ্মশ্রী পেয়ে গিয়েছেন। এতদিনে আমার কথা মনে পড়ল? পদ্মবিভূষণ বা পদ্মভূষণ হলে গ্রহণ করার বিষয় ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সেরকমই সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল।’
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পীকে পদ্মশ্রী দেওয়া তাঁকে অপমান করারই সামিল বলে মনে করছে রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। তাঁকে এবং অনিন্দ্যকে পদ্মশ্রী দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কও শুরু হয়েছে। এমনিতেই দিল্লির সাধারণতন্ত্রের দিবসের কুচকাওয়াজে বাংলার নেতাজি-ট্যাবলো বাতিলকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট জলঘোলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাংলাকে অপমান করা হয়েছে। এই আবহে বুদ্ধ-সন্ধ্যা-অনিন্দ্যকে পদ্ম সম্মান দেওয়া এবং তাঁদের তা প্রত্যাখ্যান করাকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক উঠে গেল।