কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের জীবনাবসান হয়েছে। গত মঙ্গলবার মস্কোয় তাঁর মৃত্যু হয় । বয়স হয়েছিল ৯১।
সারা পৃথিবীর মানুষকে দু’টি রুশ শব্দ শিখিয়েছিলেন মিখাইল গর্বাচভ। শব্দ দুটি হল গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ত্রৈকা। যার বাংলা অর্থ, খোলা হাওয়া এবং পুনর্গঠন। গর্বাচভ পৃথিবীকে ঠান্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, নিজের দেশে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও তিনি সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারেননি। বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁর এই ভূমিকা অনেকের মতে মানবতা এবং স্বাধীনতার পক্ষে এক আকাশ ছোঁয়া নজির। আবার এক বিরাট অংশের মানুষের কাছে তিনি খুবই বিতর্কিত। কিন্তু এটা ঠিক, ১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর , যুদ্ধ আর অস্ত্রের দুনিয়াকে শান্তির পথে চালিত করতে তাঁর প্রয়াস ছিল ঐতিহাসিক।
আলোচনার মধ্যে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া। মিখাইল গর্বাচভ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ১৯৮৭ সালে মাঝারি পাল্লার পরমাণু অস্ত্র সীমিত করার চুক্তি স্বাক্ষর করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। সেটা ছিল শান্তির দিকে এক বিরাট পদক্ষেপ। গর্বাচভই প্রথম বিশ্বের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের দরজা খুলে দিয়েছিলেন নানা সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে। দুই জার্মানির মিলনেও তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের ভূমিকা ছিল মূল শক্তি। ১৯৯০-এ তাঁকে দেওয়া হল শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার। ১৯৯১-এ ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর এত কিছুর পরও ১৯৯৬ সালে তিনি যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বরিস ইয়েলেৎসিনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন, ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ০.৫ শতাংশ।
যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বলা হত ‘আয়রন কার্টেন’-এর দেশ বা লৌহ যবনিকার আড়ালে থাকা একটি দেশ, যে দেশ ঘুরে রবীন্দ্রনাথ সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, ছাঁচে ঢালা এই ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নিয়ে, সেই দেশে গর্বাচভ চালু করলেন গ্লাসনস্তের (উন্মুক্ত হওয়া) নীিত। ফলে দেশের মানুষ সরকারের সমালোচনা করার অধিকার পেল। যা অতীতে চিন্তাও করা যেতো না। কিন্তু এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চিন্তার উদ্ভব ঘটল, যার প্রভাবে পতন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। ইউক্রেন সহ বেশ কিছু দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জন্ম হয়েছিল ১৫টি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের। যদিও গর্বাচভের শান্তি প্রক্রিয়া আজ ফের প্রশ্নের মুখে। দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু হয়েছে মহা শক্তিশালী রাশিয়ার সঙ্গে ছোট্ট স্বাধীন দেশ ইউক্রেনের। যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন গর্বাচভ দেখেছিলেন, সেখানেই আজ ভ্লাদিমির পুটিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে নির্বাচিত একনায়কতন্ত্রের।
মিখাইল গর্বাচভের সমালোচকদের মতে তিনি দেশে সমাজতন্ত্রের পতনের জন্য দায়ী। যদিও মূল ঘটনা এই যে সোভিয়েত অর্থনীতিই ভেঙে পড়েছিল। যে সমস্যা সামাল দিতে চিনকে বাজার অর্থনীতির পথে হাঁটতে হয়েছিল। যে পথে হেঁটে চিন আজ আমেরিকাকে চোখ রাঙাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন চিন্তায় সেই আধুনিকতা দেখাতে পারেনি। যদিও চিনকে গণতন্ত্রের দাবি দাবিয়ে রাখতে ঘটাতে হয়েছিল তিয়েন আন মেন স্কোয়ার। শুধু তাই নয় কখনও ভারতের সীমান্তে, কখনও হংকং-এ কখনও তাইওয়ানে চিনের যে চেহারা বিশ্ববাসীর চোখে পড়ছে, তা সমাজতন্ত্র বলতে মানুষ যা বোঝে, সেই ধারণার সঙ্গে মেলে না।
১৯৯১ সালে যে নতুন রাশিয়ার জন্ম হল, সেই নতুন দেশে রাজনীতিক হিসাবে মিখাইল গর্বাচভের তেমন ভূমিকা ছিল না। তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থেকে শিক্ষা এবং মানবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই বেশি করে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। মিখাইল গর্বাচেভের মৃত্যুতে তার প্রতি সারা বিশ্ব থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ”তিনি ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিলেন।” রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, তাকে মস্কোর নভোদেভিচি কবরস্থানে তার স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত করা হবে।