চার হাজার তিনশো ছাব্বিশ কিলোমিটার। মস্কো থেকে দিল্লির এই দূরত্বটা রাজনৈতিক ভাবে অনেকটাই কমে গিয়েছিল মিখাইল গর্বাচভের আমলে। ভারতে তখন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। গত মঙ্গলবার গর্বাচভ প্রয়াত হয়েছেন ৯১ বছর বয়সে। এই প্রসঙ্গে ফের সামনে চলে এসেছে, তিনি এবং রাজীব গান্ধী, এই দুই রাষ্ট্রনায়কের বন্ধুত্বের কথা।
সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর ফলে আচমকাই ৪০ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল প্রাক্তন বিমানচালক ইন্দিরাপুত্র রাজীব গান্ধীকে। আর তার মাত্র কয়েক মাস বাদে সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষ ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন মিখাইল গর্বাচভ। দু’জনেরই কার্যকাল প্রায় পাঁচ বছর। রাজীবকে ১৯৮৯-এ হত্যা করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা। গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রৈকার জনক মিখাইল গর্বাচভের রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়েছিল ১৯৯১-এ তাসের ঘরেএর মতো সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ায়। কিন্তু দুই রাষ্ট্রনেতার এই স্বল্পকালীন বন্ধুত্বের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল ভারতের উপর। তার একটি কারণ সম্ভবত গান্ধীর দেশ এই ভারতের সঙ্গে মিখাইল তাঁর চিন্তার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। গর্বাচভ তাঁর পাঁচ বছর সময়-কালেই পৃথিবীকে ঠান্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর , যুদ্ধ আর অস্ত্রের দুনিয়াকে শান্তির পথে চালিত করতে তাঁর প্রয়াস ছিল ঐতিহাসিক। মিখাইল গর্বাচভ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ১৯৮৭ সালে মাঝারি পাল্লার পরমাণু অস্ত্র সীমিত করার চুক্তি স্বাক্ষর করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। সেটা ছিল শান্তির দিকে এক বিরাট পদক্ষেপ। আফগানিস্তান থেকে রুশসেনা প্রত্যাহার করেও বিশ্বে শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন গর্বাচভ। যদিও তাতে আফগানিস্তানে শান্তি ফেরেনি।
ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্ব ৮০-র দশকের গোড়ায় কিছুটা থমকে গেলেও সামরিক সহায়তা এবং বাণিজ্য দুটোই ফের বেড়েছিল রাজীব জমানায়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুরোধেও রাজীব গান্ধী, পশ্চিমের ধাঁচে কোনও পাল্টা সামরিক অক্ষরেখা তৈরির উদ্যোগে শামিল হননি, ভারতের নির্জোট নীতির কথা মাথায় রেখে। সেই সময়ে রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের সোভিয়েত সফর অস্ত্র প্রাপ্তির বিচারে খুবই লাভজনক হয়েছিল। এর পিছনেও কাজ করেছিল রাজীব গর্বাচবের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক কিছুটা বোঝা যায় যখন ১৯৮৫ সালে রাজীবের সোভিয়েত সফর সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সংবাদসংস্থাকে গর্বাচভ বলেছিলেন, রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
দু’জনের সম্পর্কের গভীরতার আর একটি পরিচয় পাওয়া যায় যখন ১৯৮৫-র অক্টোবরে ব্রিটেন, বাহামা, কিউবা, আমেরিকা এবং নেদারল্যান্ড সফরেরের সময় আগে থেকে স্থির না থাকলেও আচমকাই রাজীব মস্কোয় পৌঁছে যান গর্বাচভের সঙ্গে দেখা করতে। এই নিয়ে তখন কূটনৈতিক স্তরে হৈ হৈ পড়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল গর্বাচভই চেয়েছিলেন রাজীবের সঙ্গে কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করতে। যার ভিতর অন্যতম ছিল, নিরস্ত্রীকরণ আলোচনায় বসার আগে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান সম্পর্কে আগাম জেনে নিতে চেয়েছিলেন রাজীবের কাছে। সেটাই ছিল সেই আচমকা সফরের কারণ।
গর্বাচভ ভারতে এসেছিলেন দু’বার। একবার ১৯৮৬। পরের বার ১৯৮৮তে। পরে তিনি লিখেছিলেন, তিনি ভারতে এসেছিলেন তাঁর নিরস্ত্রীকরণ ভাবনাকে এশিয়ার নেতাদের সামনে তুলে ধরতে। গর্বাচভ সেই সময়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ভারতের সংসদে। ভারতে এবং সোভিয়েত সংবাদপত্রে তার বিপুল প্রচার হয়েছিল। গর্বাচভের সময় দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়ে উঠেছিল খুবই অর্থবহ। শোনা যায়, গর্বাচভ নাকি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তিনি রাজীব গান্ধীর সঙ্গে যতটা সময় কাটিয়েছেন, তেমন পৃথিবীর আর কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে ঘটেনি।
কিন্তু এই সময়ই ভারতে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে সংসদে এসে গিয়েছে বোফোর্স ইস্যু। তার মাঝেই ১৯৮৯-এ নির্বাচন চলাকালীন নিহত হলেন রাজীব গান্ধী। আর দু’বছরের মাথায় ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাজনীতি থেকে কার্যত বিদায়ই নিলেন মিখাইল গর্বাচভ।