দ্রৌপদী মুর্মুর মতো জনজাতি গোষ্ঠীর এক মহিলাকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করে বিজেপি কিংবা এনডিএ একটা মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছে বলে বিভিন্ন মহলের দাবি। আদিবাসী মহিলাকে প্রার্থী করে বিজেপি নেতৃত্বও আত্মশ্লাঘা বোধ করছেন। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যা, তাতে দ্রৌপদীর জয় শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। বিরোধী জোটের প্রার্থী বাজপেয়ি জমানার অর্থ এবং বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিনহাও সেটা ভালোই জানেন। তবু তিনি দেশ জুড়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রথম থেকে যশবন্ত যে বিষয়ের উপর জোর দিচ্ছেন, সেটা হল, যেই রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী হন না কেন, তিনি যেন সরকারের রাবার স্ট্যাম্প না হয়ে ওঠেন। বিরোধী জোটের প্রার্থী এটাও বলছেন, এবারের রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে লড়াইটা হচ্ছে বিজেপির বিপজ্জনক নীতির সঙ্গে আদর্শের। এই লড়াইয়ে কে জিতবেন, তা দেখার জন্য আমাদের ২১ জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ১৮ জুলাই ভোট হলেও গণনা হবে ২১ জুলাই।
প্রশ্ন হল, বিজেপি হঠাৎ জনজাতি গোষ্ঠীর বা আদিবাসী সমাজের এক মহিলাকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করতে গেল কেন। এমনিতেই দেশে জনজাতি বা আদিবাসী সমাজের মধ্যে বিজেপির তেমন কোনও প্রভাব বা জনভিত্তি নেই। তা ছাড়া বিজেপি এখন গোটা দেশে মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপর বিশেষ জোর দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মতো শাসকদলের তাবড় নেতা, মন্ত্রী ইদানীং মহিলাদের ক্ষমতায়নের পক্ষে জোর সওয়াল করছেন। সেদিক দিয়ে বিজেপি এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করেছে। এই প্রথম আদিবাসী কাউকে রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড় করিয়ে বিজেপি বোঝানোর চেষ্টা করল, তারা আদিবাসী জনজাতিকে কতটা গুরুত্ব দেয়। পাশাপাশি দ্রৌপদীর মতো মহিলাকে প্রার্থী করে মোদি, শাহেরা বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা মহিলাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসতে কতটা আন্তরিক।
আরও পড়ুন: Presidential Election 2022: ‘রাবার স্ট্যাম্প’ রাষ্ট্রপতি হবেন না, দ্রোপদীকে মুর্মুকে বললেন যশবন্ত
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, জনজাতি, আদিবাসী, সংখ্যালঘু বা দলিত কাউকে দেশের সর্বোচ্চ পদে বসালেই কি তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? দ্রৌপদী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেই কি আদিবাসীদের উপর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বঞ্চনার অবসান হয়ে যাবে? তিনি রাষ্ট্রপতি হলেই কি আর আদিবাসীদের উপর উঁচু জাতির দ্বেষ বন্ধ হয়ে যাবে?
অন্যভাবে বলা যায়, যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ রাষ্ট্রপতি হতেন, তা হলে কি আজকের ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর সমস্ত অত্যাচার বন্ধ হয়ে যাবে? বিজেপি আর দেশে হিন্দু, মুসলমান নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করবে না? বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নেতা, মন্ত্রীরা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করবে না?
এর স্পষ্ট উত্তর, কখনওই তা সম্ভব নয়। এর আগে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদাভুক্ত ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাতে মুসলিম সমাজের কোনও উন্নতি হয়নি। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এমনটা নয়।
একইভাবে গতবার রাষ্ট্রপতি পদে এনডিএ প্রার্থী করেছিল দলিত রামনাথ কোবিন্দকে। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে কি দেশে দলিতদের উপর অত্যাচার বন্ধ হয়েছে? দলিতদের আর্থ সামাজিক উন্নতি ঘটেছে?
এক কথায় জবাব, না।
তবু জনজাতি তাস খেলার জন্যই এবার এনডিএ কিংবা বিজেপি ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন রাজ্যপাল ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের বাসিন্দা আদিবাসী জনজাতির দ্রৌপদীকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করেছে। তিনি প্রার্থী হওয়ার পরেও মাত্র তিনদিন আগে মধ্যপ্রদেশের এক গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিবাদের জেরে এক দলিত মহিলাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম বিভাজন কতটা প্রকট হলে উদয়পুর কিংবা অমরাবতীর মতো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে, তাও আমরা দেখলাম।
আসলে হল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। শুধু রাজনৈতিক ফয়দা তোলার জন্য চমক দিলাম, আদিবাসী মহিলাকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করলাম, তাতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এটা ভাবাই বাতুলতা।
তার মধ্যে বিরোধী জোটের অন্যতম মুখ, যিনি বিরোধীদের পক্ষ থেকে সর্বসম্মত রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এখন বলতে শুরু করেছেন, আদিবাসী মহিলাদের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। বিজেপি আগে যোগাযোগ করলে রাষ্ট্রপতি পদে একজনই প্রার্থী হতে পারতেন। এখন আর সে সব সম্ভব নয়।
তাঁর এই বক্তব্যের পর পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটা দেখার জন্য ভোট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই আবারও বলছি, এনডিএ প্রার্থী দ্রৌপদীর জয় এক প্রকার নিশ্চিত। তবে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেই জনজাতি গোষ্ঠীর সব সমস্যার একেবারে রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা কখনওই নয়।
আরও পড়ুন: Presidential Polls: ছক্কা হাঁকালেন মমতা, যশবন্তের প্রচার শুরু সিপিএমের কেরল থেকে
তবে এটুকু বলা যেতে পারে, দেশে যখন জনজাতি এই মুহূর্তে প্রায় ১০ শতাংশ, তখন সেই গোষ্ঠীর কাউকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করে এনডিএ দরজাটা খুলল। সেই দরজা খুলতে লেগে গেল দীর্ঘ ৭৫ বছর।