তাঁর ছোঁয়াতেই অসুস্থ রোগী সুস্থ হয়ে যেত। আবার তাঁর ছোঁয়াতেই নতুন প্রাণ পেয়েছিল বাংলা।
১৮৮২-র ১ জুলাই। এই দিনেই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জন্ম। জন্মদিনকে তিনি নিজেই স্মরণীয় করে রেখেছেন মৃত্যু দিন দিয়ে। একই দিনে জন্ম মৃত্যু যাঁদের, তাঁদের পথ আর পাঁচ জনের চেয়ে আলাদা। একাধারে তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং চিকিৎসাবিদ।অকৃতদার এই মানুষটি শেষ বয়সে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর আয়ু আর বেশিদিন নেই। অসুস্থ অবস্থায় অল্প কয়েকদিন পরেই তিনি মারা যান।
চিকিৎসক হিসেবে যেমন বিধান চন্দ্র ছিলেন কিংবদন্তি, তেমনি রাজনীতির ময়দানেও তিনি ছিলেন চৌখস। জওহরলাল নেহরুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। তাঁর চিকিৎসাও করতেন ডাঃ রায়। তবে ডাঃ রায়ের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলেই ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতার বছরে ১৫ অগাস্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ। ডাঃ রায় ছিলেন সেই মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী।
গান্ধীজি একবার ডাঃ রায়কে বলেছিলেন, ”আহা আপনি যুক্ত প্রদেশের গভর্নরের পদগ্রহণ করতে রাজি হলেন না। আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে ইওর এক্সেলেন্সি বলে ডাকতে পারব। তা হতে দিলেন না।” ডাঃ রায় হেসে উত্তরে বলেন, “ আমি আপনাকে আরও ভালো বিকল্প দিতে পারি। আমি পদবিতে রয়, তাই আপনি রয়্যাল বলতে পারেন। আর যেহেতু অনেকের চেয়ে লম্বা, সেহেতু রয়্যাল হাইনেস বলতে পারেন। সেটাই যথার্থ।“ সেদিন বিধান রায় গভর্নর হতে চাননি। পরবর্তীকালে তিনিই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি বিধানসভায় নির্বাচিত হন। প্রফুল্ল ঘোষ ইস্তফা দেওয়ার পরে ১৫ জানুয়ারি তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন।
১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে বিধান রায় এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ দুই রাজ্যের মিলনে পূর্ব প্রদেশ নামে একটি নতুন রাজ্য গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তা সমর্থন করেন। বামেরা বাংলা-বিহার সংযুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে বিধান রায় চাপে পড়ে ওই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। গত শতকের পাঁচ, ছয়, সাতের দশক ছিল রাজনৈতিক ঘটনার ঘনঘটায় ভরা। ১৯৬২ সালের ১ জুলাই ডাঃ রায় মারা যান। তার মাত্র মাস চারেক আগেই তিনি সিপিআই প্রার্থী বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়কে হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। কেন্দ্র- রাজ্যের বিরোধ আগেও ছিল, এখনও আছে। সেই সময় তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা অনেকটা এইরকম। তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণ মাচারিয়াকে তিনি বলেন, “তোমরা দিল্লির নেতারা কলকাতার মধু নিতে খুব পটু, আর পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়ার ব্যাপারে বৃদ্ধার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠী ?”
আগেই বলেছি, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে বিধান রায়ের সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো। বিধানসভায় তাঁদের মধ্যে তর্কযুদ্ধ ছিল দেখার মতো। বিধানসভার বাইরে আবার দুজনের মধ্যে পুরো দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল। বিধানবাবু অনেকবার জ্যোতিবাবুকে তাঁর নিজের পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আজকের দিনে এই সব তো ভাবাই যায় না।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। যতদূর জানা যায়, ডক্টরস ডে-র ধারণাটা ছিল জর্জিয়ার উইন্ডার-এ চিকিৎসকের স্ত্রী মিসেস ইউডোরা ব্রাউন আলমন্ডের মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৯৯০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বুশ একটি বিল স্বাক্ষর করার পরে, ডাক্তার দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় ডাক্তার দিবসে পরিণত হয়েছিল। বিধান চন্দ্র রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ১৯৯১ সালে ভারতে প্রথম ডাক্তার দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
সাধারণ মানুষের জন্য তিনি দেশে দুটি স্বনামধন্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯২৮ সালে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া গঠনের পিছনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৯৩৯-এর পর থেকে তিনি ইন্ডিয়ান ইন্সিটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ, কলকাতার প্রথম স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল কলেজ করার ব্যাপারে এগিয়ে আসেন।
আজকের আধুনিক বাংলা বিধান চন্দ্র রায়ের তৈরি। কলকাতা বন্দর থেকে শুরু করে কল্যাণীর মতো উপনগরী, দুর্গাপুর-আসানসোলের মতো শিল্পাঞ্চল, সব কিছুরই স্থপতি বিধান রায়। ভারী শিল্প এবং সমস্ত নতুন নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর সবই তাঁর নিজের হাতে করা।