কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক : ‘আমি জানি, মানুষ মুখেই জগৎ জয় করেছে। খুব সামান্যই অর্জন করেছে লিখে। পৃথিবীর বড় বড় আন্দোলন সংগঠিত ও দানা বেঁধেছে মহান বাগ্মীদের জন্য, লেখকদের জন্য নয়।’ পৃথিবীর সর্বোত্তম বিতর্কিত ব্যক্তি অ্যাডলফ হিটলারের আত্মজীবনী ‘মাইন কামফ’ (আমার সংগ্রাম, ১৯২৫) বইতে একথা লিখেছিলেন তিনি। নিজে ছিলেন অসাধারণ বক্তা। তাঁর গবেষক, পরিচিত ও ঘনিষ্ঠদের বিভিন্ন স্মৃতিকথায় জানা গেছে, হিটলার নিজে লিখতেন ভাষণ। তারপর অন্তত পাঁচবার সেই লেখা সম্পাদনা করতেন। কাউকে বিশ্বাস করতেন না বলে সেই লেখা কেউ দেখতে পেত না।
তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই ভাষণের মহড়া দিতেন। দেখে নিতেন মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর ও হাতের সঞ্চালনা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা। সেই মহড়ায় তাঁর ব্যক্তিগত চিত্রগ্রাহক শয়ে শয়ে ছবি তুলতেন, যা দেখে নিজেকে সংশোধন করতেন হিটলার। জার্মান পার্লামেন্টে তাঁর প্রখ্যাত ভাষণ রেডিওয় শোনানো হতো এবং সেই সময়ের তুলনায় অত্যন্ত দুঃসাধ্য হলেও ভিডিও করা হতো। শুধু তাই নয়, তাঁর প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসকে দিয়ে তিনি মিথ্যা তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভোজবাজিতে সত্য বলে প্রচার করাতেন। এতগুলো কথা লেখার একটাই উদ্দেশ্য— এদেশে এরকমই কাউকে চেনা চেনা লাগছে কি?
নিন্দুক বা তোষামুদেরা যা বোঝার বুঝুন, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক! বৃহস্পতিবার থেকেই আমরা জানি যে, ভারত টিকাসভায় ‘শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ছে। দুপুর থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে হীরকরাজের দুন্দুভি বাদন। মুখোশহীন গেরুয়ামুখো কিষ্কিন্ধ্যা সেনারা তাসা, ভেঁপু বাজিয়ে মাটি কাঁপিয়ে লম্ফন-নৃত্য করছে। কোভিড বিধি মেনে চলছে লাড্ডুমুখ, আবিরখেলা। তাতেও রাতে ঘুম এল না। শুক্রবার (জুম্মাবার) সকালে ঘটা করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ভারতকে গর্ববতী করে তুললেন প্রধানমন্ত্রী।
আরও পড়ুন – আমি ভারতের তৈরি কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন নিয়েছি: রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার সভাপতি
১০০ কোটি টিকাকরণ দীর্ঘ শ্রম, সাধনা, সম্মিলিত প্রয়াস, ভারতীয় বিজ্ঞানের উন্নতি— এসবের মিলিত ফসল। এর কোন কথাটা অতি অশিক্ষিত মানুষও জানেন না, বোঝেন না! যা হয়েছে, সেটাই তো সরকারের কাজ। না হওয়াটাই অনুচিত, নিন্দনীয়। দৌড়ে প্রথম হলে দর্শকরা তারিফ করে, এখানে দেখা গেল প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ১০০ কোটি টিকার প্রশংসা কুড়োতে আয়নার (ক্যামেরা) সামনে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ালেন প্রধানমন্ত্রী। বললেন, টিকাকরণ হয়েছে বিনামূল্যে। তাহলে বেসরকারি হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে যে টাকা দিয়ে হাজার হাজার মানুষ টিকা নিয়েছেন, সেটা কি মিথ্যা? তাহলে কেন এমনটা হল? এর কি কোনও প্রয়োজন ছিল?
হ্যাঁ, এর প্রয়োজন ছিল। কারণ বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এখন সাবান, শ্যাম্পু, বাইক, গাড়ির মতো একটি বিপণন কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। তাই নতুন কোনও প্রোডাক্ট বাজারে নামার আগে থেকেই চলতে থাকে প্রচার। বাজারে নামলে তো কথাই নেই। সে কারণে ১০০ কোটির টিকাকরণ নিয়ে ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর কর্মচারীদের সামনে ভাষিয়ে দিলেন। বিন্দু বিন্দুতে সিন্ধু— আপ্তবাক্যটি সত্য হলে এই প্রচারের সার-জলে ফল ফলবে উত্তরপ্রদেশে, এমনকী ‘২৪ সালের লোকসভাতেও।
আরও পড়ুন – একশো কোটির আদিখ্যেতা
সরকারি তথ্যই বলছে, প্রাপ্তবয়স্কদের এখনও প্রথম ডোজের টিকাকরণ হয়েছে ৭৫.৩ শতাংশের মতো। আর দুটো ডোজের টিকা পেয়েছেন ৩১.৩ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য, বাদ রয়েছে ১৮ বছরের নীচে বসবাসকারী ‘নাগরিক’রা। শিশু-কিশোররা এই পরিসংখ্যানের বাইরে রয়ে গেছে। সেই সংখ্যাটা কত, তা কি বলা হল ভাষণে? তাদের অনেকেরই কিন্তু স্কুল খোলার সময় এসে গেছে। এসব ছেড়ে ১০০ কোটির সংখ্যাটাকেই আঁকড়ে ধরে সাফল্যের শ্যাম্পেনের বোতল ঝাঁকিয়ে দিল কেন্দ্র।
এর একমাত্র কারণ হল, লখনউ বিজয় অভিযান। তা না হলে ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গাল দেওয়া বিজেপির যোগী সরকার বিদ্যার্থীদের ট্যাবলেট/ল্যাপটপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নেবে? দেখাদেখি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও ভোটে জিতলে পড়ুয়া মেয়েদের জন্য ট্যাবলেট/ল্যাপটপ, ব্যাটারিচালিত স্কুটি উপহার দেবেন বলে জানিয়েছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সব দলকেই শেষমেশ মমতার পথে এগোতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন – উত্তরপ্রদেশের ভোটে জিতলে মেয়েদের স্মার্টফোন ও স্কুটি দেবে কংগ্রেস
তফাত এটুকুই মমতা কারও নকল করার উদ্দেশ্যে নয়, জনস্বার্থে করছেন। আর তাঁকে অনুকরণ ও অনুসরণ করতে হচ্ছে বিজেপি-কংগ্রেসকে। হয়তো দেখা যাবে, কিছুদিনের মধ্যেই দুয়ারে রেশন প্রকল্প চালু হতে চলেছে যোগী রাজ্যে। একই কথা ইস্তাহারে লিখবে কংগ্রেস, সপা এবং বসপা।
অতএব, ফের প্রচারের গ্যাস বেলুন উড়িয়ে দেশের দন্তহীন মানুষকে দেওয়ালির তোফা হিসেবে আখরোট দিলেন মোদি। থালা বাজানো কিংবা প্রদীপ জ্বালানোর মতো সম্মোহনবিদ্যার সাফল্যের পর জাতিকে এক ঢোঁক ‘ব্রেনোলিয়া’ সেবন করালেন হেমন্ত-প্রভাতে।