কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক : পুজো শেষ। লক্ষ লক্ষ মানুষের কোভিড বিধি মান্য করে ঠাকুর দেখা হল! ঢাকের বোলে নৃত্যের তালে মুখোশহীন নিরঞ্জনও চলছে। ক্যামেরার মুখোমুখি সিঁদুর খেলায় করোনার ছোঁয়াছুয়ির পালাও সম্পন্ন। এবার তৃতীয় ঢেউয়ের মারণ উৎসবের আগমনি সুর ভেসে আসবে ধীরে ধীরে। আনন্দের স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে, তালজ্ঞানহীন অনেকের যেমন সলিল সমাধি ঘটে, এও খানিকটা তেমনই। করোনার তৃতীয় সুর লেগেই ছিল, জানা সত্ত্বেও নির্বুদ্ধি-বাঙালি তাতে অবোধের ষষ্ঠ সুর বসিয়ে দিল। এখন কৈলাসে পৌঁছে হর-পার্বতীর মর্ত্যবাসীর প্রতি কৌতুক করা ছাড়া আর কাজ থাকবে না।
করোনার জন্য গোটা পৃথিবীর আর্থিক মেরুদণ্ড কয়েকশো বছরের জন্য বেঁকে গেছে। দেশের কয়েক লক্ষ মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন-নিম্নবিত্ত হয়ে গেছে। কিন্তু, উৎসবে ভাটা নেই এদেশের। বিশেষত ঠাকুর-দেবতা হলে তো কথাই নেই। তাই কুম্ভমেলা হল, চারধাম যাত্রা হল, গণেশ পুজো, ওনাম এমনকী দুর্গাপুজোও। কিন্তু, খুশির ইদে পড়ল কোভিড কাঁটা। ততোধিক আশ্চর্য, এসব নিয়ে কোনও রাজ্য কিংবা কেন্দ্র কোনও ব্যবস্থা নিল না। কথায় বলে, হয় দেখে শেখে, নয়তো ঠেকে শেখে। আমরা তো দেখছি, কোনওটাই শিখিনি। ফলে এখন উল্টো গাধার পিঠে চাপা ছাড়া উপায় নেই। যদি না মৃত্যুপথের এই জঙ্গলে ভূতের রাজার মতো কোনও বর পাওয়া যায়।
কেন এই পুজো, কেন ধুমধাম করে ধর্মের ব্যবসা? সাধারণ মানুষের মধ্যে গোয়েবলসের মতো প্রচার করা হয় যে, এতে নাকি মুদ্রাচক্র আবর্তিত হয়। অর্থের হাত-ঘূর্ণনে অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। আদপেই তা নয়। একটা উৎসবকে কেন্দ্র করে ফড়ে বা দালালদের মাধ্যমে অর্থনীতি কেন্দ্রীভূত হয় একমুঠো ধনাঢ্য কিংবা বহুজাতিকের হাতে।
ধরা যাক একজন চা-ওয়ালার কথা। ৫ বা ১০ টাকায় তাঁকে বেচতে হয়। তার জন্য তাঁকে কিনতে হয়, চা পাতা। এই বিপুল পরিমাণ চা পাতা (ভেজাল মিশ্রিত) কেনার টাকা শেষমেশ যায় চা বাগান মালিকের পকেটে। দুধ, চিনিও তাই। গ্যাস ও কেরোসিনের লভ্যাংশ যায় ফড়ে ও দালালদের পকেটে। কাগজের বা প্লাস্টিকের কাপ কেনার টাকাও যায় হাত ঘুরে ধনী ব্যবসায়ীদের পকেটেই। অস্থায়ী দোকান দেওয়ার জন্য স্থানীয় দাদাদের খুশি করতে হয়। সব বিনিয়োগের পর চাওয়ালা আহ্লাদিত হয়ে পড়েন তাঁর লাভ দেখে। এখানেও সেই অশিক্ষাজনিত নির্বুদ্ধিতার কারণে তিনি কায়িক শ্রমকে লাভের হিসাবের বাইরে রাখেন। সুতরাং, সব মিলালে তাঁর হাতে থাকবে শূন্য এবং তাঁর বিনিয়োগকৃত টাকা পুঞ্জীকৃত হবে কয়েকটি মুঠোয়। তাই বিপণনকারী ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রকে পিছন থেকে উৎসাহিত করে এ ধরনের পুজো, তীর্থযাত্রা, উৎসব যেন কোনওমতেই বন্ধ না হয়। ধর্মের সুড়সুড়িতে যে গাধাও হাসে, গণ্ডারও হাসে। কারণ কোভিড আবার বাড়লে পরোক্ষে লাভবান হবে পণ্য ব্যবসায়ীদের ভায়রাভাই বহুজাতিক ওষুধ বেওসায়ীরাই। তাদের সকলের একটাই স্লোগান— যত আনন্দ, তত লাভ। যত মড়ক, তত লক্ষ্মী।
দুটো ধাক্কা সামলে যখন দেশ একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছিল, তখন ফের তৃতীয় ধাক্কার আবাহনটা কি না করলেই হতো না! পুজো মণ্ডপে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দূরত্ববিধি কি ঠেকানো গেল? দু’বছর পর দীপাবলির শেষেই স্কুল-কলেজ খোলার কথা। চলছে অফিস-আদালত। বর্ষা বিদায় নিলেই বাতাসে আসবে হিমের পরশ। করোনা-বরণের আদর্শ সময়। পরিসংখ্যানও বলছে, গুটিবসন্তের একটি-দুটি গুটির আকারে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সময় অনুযায়ী, কোভিড-লগ্নও সমাগত। অতএব, জোট বাঁধ, তৈরি হও…করোনা নয়, তোলো আওয়াজ। যদিও এ আওয়াজ বধিরের কানে তোলা। কারণ প্রকারান্তরে মানুষ অসুরেরই উত্তরসুরি। তাই লোভ, রিপু, লালসা জয় করতে শেখেনি। সামান্য শক্তি অর্জনেই নিজেকে সর্বশক্তিমান ভাবে। সে কারণেই হয়তো চরিত্রগত ত্রুটিতেই ট্র্যাজেডির নায়ক হতে হয়। যাকে ঈশ্বর বিশ্বাসীরা মনে করেন, দেবতার অভিশাপ।