মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২২ জানুয়ারি, যেদিন রামমন্দির উদ্বোধন হবে সেদিনেই তাঁর দলের কর্মসূচির ঘোষণা করলেন। সাতসকালে তিনি যাবেন কালীঘাটে, পুজো দিয়ে সেখান থেকেই মিছিল, মসজিদ, গুরুদ্বারা, চার্চ হয়ে মিছিল পৌঁছবে পার্ক সার্কাসে। সেই পার্ক সার্কাস যেখানে কংগ্রেসের অধিবেশনে মেজর সত্য গুপ্তের ট্রেনিং নিয়ে সেনা পোশাকে যুবকেরা প্যারেড করেছিলেন, সেলামি নিয়েছিলেন ঘোড়ায় চড়ে, সামরিক পোশাক পরে সুভাষচন্দ্র বসু। গান্ধীজি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন পার্ক সার্কাসের সার্কাস। তো এবারে পার্ক সার্কাসে তৃণমূলের এই ঘোষিত কর্মসূচির পরেই ব্যঙ্গটা এসেছে সিপিএম-এর তরফ থেকে। তাঁরা বলেছেন এ হল গিয়ে এক প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। মানে নরেন্দ্র মোদি যা করছেন, আরএসএস–বিজেপি যা করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটাই করছেন, প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, কে কত বড় সাম্প্রদায়িক হতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে রোখা যায় না। মানে ২২ তারিখ নরেন্দ্র মোদি যা করছে করুক, হিন্দু ধর্মের মানুষদেরকে যেরকমভাবে বোঝাতে চাইছে বোঝাক, হিন্দু ধর্মের সহিষ্ণুতাকে সরিয়ে রেখে দেশের মানুষকে এক উগ্র মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে যাক, আমাদের কিছু করার দরকার নেই। সত্যিই তো গণশক্তি খুলে দেখুন, ২২ জানুয়ারির কোনও সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং ইত্যাদির কোনও খবর নেই। দলের মুখপত্র গণশক্তির দুইয়ের পাতায়, যেখানে আগাম সমস্ত পরিকল্পনার কথা জানানো হয়, সভা সমাবেশের কথা জানানো হয়, সেখানে এমন কিছু নেই। নরেন্দ্র মোদির উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার, হিন্দুত্ব ছড়িয়ে ভোটারদের মেরুকরণের চেষ্টার বদলে মমতা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ডাক দিয়েছেন। মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বারা, গির্জা হয়ে এক মিছিল আয়োজনের কথা জানিয়েছেন, সেটা নাকি প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। শুনেই মনে হল এটাকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে, যিনি এমন কথা বলেন তাঁর এমন কথা বলার অর্থ কী তা জানা দরকার তাই সেটাই বিষয় আজকে, সীতারাম… সীতারাম…।
যিনি গতকাল সাংবাদিক সম্মেলনে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার কথা বললেন, সেই সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি মাত্র ক’দিন আগেই এক ভিডিও বিবৃতিতে বলেছেন, নাম আমার সীতারাম, সেই কারণেই জানি ধর্মের অর্থ কী। ধর্ম এক আত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক। কোনও ব্যক্তির কাছে পরমাত্মা কী সেটা স্থির করবে সেই ব্যক্তির আত্মা, হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ যা সেই ব্যক্তি চান। একবার সেই ব্যক্তি এটা স্থির করার পরে অন্য কারও হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সেই কারণে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে একটা লাইন আছে। সেই লাইনকে লঙ্ঘন করা লক্ষ্মণ রেখাকে লঙ্ঘন করার মতোই বিষয়। অযোধ্যায় মন্দিরের উদ্বোধন ধর্মের রাজনীতিকরণ। ধর্মের রাজনীতিকরণের বিরোধিতা করেই আমরা অযোধ্যায় যাচ্ছি না। ধর্মের স্থান তার জায়গায়, যে ভাবনাকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে জুড়ে যেন খেলা না হয়।
আরও পড়ুন: Aajke | আবার মুখ পুড়ল সিপিএমের, এটাই শেষ নয়, আরও আছে বাকি
পুরো বিবৃতিটাই দিলাম, উনি নিজেই বলেছেন যে ওনার নাম সীতারাম বলেই উনি ধর্মের মানে জানেন, মার্কস, এঙ্গেলস বা লেনিনের নাম তো সীতারাম ছিল না, কাজেই ওনারা ধর্ম না জেনেই ধর্ম আর সমাজ নিয়ে দিস্তে দিস্তে লিখে গেছেন। থাক মার্কসের কথা, এই সীতারাম ইয়েচুরির দল বেশিদিন নয়, মাত্র নয়ের দশকে এই বাংলাতেই বিবেকানন্দ, রামমোহন, বিদ্যাসাগরের ছবি ঝুলিয়ে ভোট চেয়েছেন, তখন সেটা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে সব ধর্মের মানুষ মিলেই বিরাট মিছিল করেছেন, তখন সেটা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ২৩ জানুয়ারি, ২০১৩ কেরালার বিভিন্ন শহরে পোস্টার ছেয়ে গিয়েছিল, পোস্টার ছাপিয়েছিলেন রাজ্য যুব ফেডারেশনের নেতারা, তাতে লেখা ছিল কাস্টলেস সোসাইটি, সেকুলার কেরালা, উপরে ছবি স্বামী বিবেকানন্দের, সেই পোস্টারেই শিকাগো বক্তৃতার কিছু লাইনও ছিল। সেই সময়ের যুব ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন অসুবিধেটা কোথায়? বিবেকানন্দ কারও সম্পত্তি নয়। সেদিন রাজ্যজুড়ে পদযাত্রা হয়েছিল, সেই যাত্রা ১৮৯২-তে যে সোরানুর থেকে বিবেকানন্দ পদযাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই জায়গাতেও যায়। সেটা যুব আন্দোলন ছিল, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। অত পিছনে যাওয়ারও দরকার নেই, মাত্র ২০২২-এ সিপিএম-এর ২৩তম পার্টি কংগ্রেস হয়েছিল মালাবারের কান্নুরে। সেখানে বিভিন্ন ট্যাবলো সাজানো হয়েছিল, তারমধ্যে একটা ট্যাবলোর ছবি দেখুন, মধ্যে থেইয়াম নাচের মূর্তি, একটা নৃত্যশৈলী যেখানে মা কালীর মতো একজন দেবীর আঙ্গিক থাকে, হিন্দু ধর্মের রীতিনীতির মধ্যেই পড়ে এবং পাশে বিবেকানন্দের ছবি। সেটা কিন্তু বিপ্লব ছিল, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। আসলে বহু প্রচলিত কথা, একটু বদলে নিয়ে বলাই যায়, হায় সিপিএম, তুমি করলে লীলা আর মমতা করলে বিলা? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিবেকানন্দের ছবি নিয়ে সিপিএম মিছিল করে, সমস্ত ধর্মের মানুষ নিয়ে সিপিএম সংহতি মিছিলের আয়োজন করে, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২২ জানুয়ারিতে সেই সংহতি মিছিলের ডাক দিয়েছেন বলে তাঁকে সাম্প্রদায়িক বললেন সিপিএম সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, আপনারা এ নিয়ে কিছু বলবেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
তো সেই সীতারামের আরেকটা গল্প বলি, না না রামসীতা নয়, সীতারাম ইয়েচুরি। তখন সীতারাম কেন্দ্রীয় কমিটিতে, ওদিকে জেএনইউর ছাত্র হিসেবে নেপালের নকশাল নেতা প্রচণ্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে, সেই নেপালে যাবেন জ্যোতি বসু, সঙ্গে যাবে কে? সীতারামকেই বাছা হল। তিনি গেলেন জেবি-র সঙ্গে, কমিউনিস্ট পার্টিতে জ্যোতি বসুকে জেবি বলেই ডাকা হত। জ্যোতি বসু তখনও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কাজেই নেপাল সরকার জ্যোতিবসুকে কাঠমান্ডু ঘোরানোর ব্যবস্থা করল, ওনাকে নিয়ে যাওয়া হল স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে, সেখানে এক্কেবারে বিগ্রহের সামনে, পুরোহিত জ্যোতি বসু আর সীতারামকে পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ দিতে চাইলেন, জ্যোতিবাবু যথারীতি না না ওসবের দরকার নেই বলেই দিলেন, কিন্তু সীতারাম নিয়েছিলেন। কেন? পরে সীতারাম জানিয়েছিলেন ওনার অশীতিপর বাবার এই উপহারটা খুব পছন্দ হবে, তাই উনি ওটা নিয়েছিলেন। আমার জানতে ইচ্ছে করে ওনার বাবা তো মারা গিয়েছেন, সেই পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষটা কি সীতারাম ইয়েচুরি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন? মানে ওনার নাম তো সীতারাম, ধর্ম জানেন, ধর্মই বলছে পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ জীবনে উন্নতি আনে।