শাস্ত্র বলছে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না। বিজ্ঞান বলছে কার্বাইড দিয়ে কাঁচা এঁচোড়কে কাঁঠাল বানালেও স্বাদে গন্ধে তেমন একটা ভালো কিছু হয় না। মানে হল, সবকিছুর বেড়ে উঠতে, পূর্ণতা পেতে একটা সময় লাগে, এক পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই তা পূর্ণতা পায়। আপনার মনের সব আবেগ দিয়েই সত্তরের দশক তো মুক্তির দশক হয়নি, কিন্তু সেই ৫৬-৫৭ থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের শেষটাতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। রাহুল গান্ধী চাইবেন আর মহব্বত কা দুকান খুলে যাবে মোড়ে মোড়ে এমনটা হবে না, তার জন্য এক পরিকল্পনা দরকার, সময় মেনে কিছু কাজ করা দরকার। উইশফুল থিঙ্কিং দিয়েই কাঠাঁলও পাকে না, রাজনৈতিক পালাবদল হয় না। তো এই সন্দেশখালি এপিসোড সামনে আসা ইস্তক সেই আবেগ সর্বস্ব বাঙালির মধ্যে কেউ কেউ বলে ফেলছেন সন্দেশখালি হয়ে উঠবে ওয়াটারলু, সন্দেশখালি হয়ে উঠবে নন্দীগ্রাম। যা বলতে চাইছেন তার সোজা বাংলা হল সন্দেশখালি রাজ্য জোড়া অসন্তোষের আগুন জ্বালিয়ে দেবে। রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সেই আগুনে জনবিচ্ছিন্ন হবে মমতা সরকার আর ব্যস, সামনের নির্বাচনে পপাত চ, মমার চ। একদল ভাবছেন আবার ফিরে আসবে অষ্টম বাম সরকার, অন্যদল ভাবছেন রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এরকম কি প্রথমবার নাকি? না তাও নয়, বাজির আগুনে বা বিরোধীদের বলা বোমার আগুনে ছিন্নভিন্ন দেহের ছবি আমরা দেখেছি, ৯/১০/১১ জনের লাশ দেখেছি। তখনও বলা হয়েছিল একই কথা, বগটুইয়ের ঘটনার পরেও এরকম কথা শুনেছি, সন্দেশখালির ঘটনার পরেও শুনছি। কিন্তু তা কি সত্যিই রাজ্যজুড়ে খাদ্য আন্দোলন, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সাড়া তুলেছে? বা তুলতে পারে? সেটাই বিষয় আজকে সন্দেশখালি কি নন্দীগ্রাম হয়ে উঠছে?
যা যা আমাদের দেশের বা রাজ্যের নির্বাচনে ওলটফের এনেছে তা কীরকম ছিল? আমরা আপাতত সেই আলোচনাটা রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। ৫২ সাল থেকেই কংগ্রেসি সরকার, স্বাভাবিক, কারণ তার প্রেক্ষিত ছিল স্বাধীনতা আন্দোলন, কংগ্রেসের ভূমিকা। এবং বামপন্থীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় বলার মতো এক শিশুসুলভ আচরণ।
আরও পড়ুন: Aajke | সন্দেশখালি, আরও কিছু জরুরি কথা
মাঠ খোলা ছিল কংগ্রেসের জন্য, ছিলেন বিধান রায়ের মতো নেতা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর আগে থেকেই একের পর এক আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন বামপন্থীরা, কংগ্রেসও ভেঙেছে, কিন্তু শেষ হয়েছে কি? জোড়াতাপ্পি দিয়ে কংগ্রেস বিরোধী সরকার তৈরি হয়েছে, কংগ্রেস মুছে গেছে কি? না, যায়নি। কবে এটা হল? জরুরি অবস্থার পরে। এক প্রবল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার মানুষ কংগ্রেস দলকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপরে ৩৪ বছরের বাম শাসন। সবটাই কি ধনধান্য ফুলে ফলে ভরা? না। অজস্র ঘটনা ঘটেছে। অজস্র উদ্ধত মুখ আমরা দেখেছি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, প্রতিবাদও হয়েছে। কলকাতার রাস্তাতেই পুলিশের গুলিতে লাশ পড়েছে ২১ জুলাইয়ে, সরকার পড়েনি। এরই মধ্যে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল। বামেদের আরও খানিক অক্সিজেন। কিন্তু সাত তাড়াতাড়ি এক কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো নেতার শিল্পায়নের তাগিদ গোটা রাজ্যে এক অন্য বার্তা ছড়িয়ে দিল। উনি কী চেয়েছিলেন, কী প্রচার হল ইত্যাদি বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় উন্নয়নের এই বার্তার পিছনে ছিল জমি হারানোর ভয়, সেও আবার ছোট জমির মালিকদের। দক্ষিণবঙ্গের সংখ্যালঘু মানুষজনের কাছে এই বার্তা পৌঁছে গেল। সেটাই ছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অভিঘাত। রাজ্যের গরিব প্রান্তিক কৃষক সংখ্যালঘু মানুষেরা বাম সরকারের বিরুদ্ধে গেল, সরকার পড়ে গেল। এই সরকারের আমলে লাগামহীন দুর্নীতি আছে। সেই কবেই তো ক্যামেরার সামনেই আমরা এই সরকারের এমনকী আজকের বিজেপি দলের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীকেও তো মানুষ দেখেছেন হাতে করে টাকা নিতে, কিন্তু সরকার পড়েনি, কারণ আপাতত মানুষ মনে করে রাজনৈতিক নেতারা তো চুরি করবেই। তৃণমূল জমানাতে কিছু জায়গায় মানুষের জায়গা জমি নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, বিরোধিতা হয়েছে বইকী। কিন্তু খেয়াল করুন সেই ভাঙড়ে বা দেউচা পাচামিতে সরকার পুলিশ নামিয়ে গুলি চালিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টাও করেনি। মাঠে নামিয়েছে পরমব্রতকে, নামিয়েছে নো ভোট টু বিজেপির ডাক দেওয়া এক সংখ্যালঘু নেতা সামিরুল ইসলামকে। কাজেই সেসব আন্দোলন সেই এলাকাতেই বিরাট প্রভাব ফেলেনি বা ফেললেও তা থিতোতে সময় নেয়নি। আর কী? কিছু জায়গায় সরকারি দলের, তৃণমূলের মাঝারি নেতাদের অত্যাচার, ঔদ্ধত্যের ছবি এসেছে, তাদের বিশাল বাড়ির ছবি নিয়ে সিরিজ তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা কি সারা রাজ্যের প্রান্তিক মানুষদের কাছে কোনও বার্তা দিতে পেরেছে? ক্যামেরার সামনে শাহজাহানের বাহিনী আমাদের রাতে ডেকে পাঠাত, নিশ্চয়ই এই কথাতে সত্যি তো অনেকটাই আছে, যেমনটা লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন তেমনটা তো সত্যি নয়। কিন্তু এই বার্তা কি অন্য জেলায় অন্য গ্রামের মানুষের কাছে গেছে? বা গেলেও তাঁরা তাঁদের বাস্তবতার সঙ্গে মিল পাচ্ছেন? মানে এরকমটাই কি অবস্থা যে রাজ্য জুড়ে মহিলাদের রাত হলেই তৃণমূল দফতরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তা তো নয়, কাজেই এই আন্দোলন এক লোকাল ফিনোমেনন হয়েই থেকে যাচ্ছে। কিছু মানুষ বিরোধী হয়ে উঠছেন, কিছু বিরোধী ভোট বাড়বে, এমনকী যদি ধরেই নিই যে সন্দেশখালি তৃণমূল হেরেই যাবে তাহলেও তা কি রাজ্য জুড়ে কোনও অভিঘাত তৈরি করছে? আমরা জানি, বিরোধী নেতারাও জানেন করছে না। কিছু আবেগপ্রবণ সাংবাদিক বা রাজনৈতিক কর্মী সন্দেশখালিকে নন্দীগ্রাম বা ওয়াটারলু হয়ে উঠতে দেখতে চান, কিন্তু তাঁরা চাইলেই তো হবে না, বাস্তব অবস্থা তা নয়। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম যে সন্দেশখালির ঘটনা কি সারা রাজ্যজুড়ে এক রাজনৈতিক পালাবদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে? সন্দেশখালির প্রতিবাদ কি সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে? শুনুন মানুষজন উত্তরে কী বলেছেন।
ইতিহাস রচনার উপাদান আর তার গতিপথ বলে যখন এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এক বিরাট এলাকাজুড়ে আলোড়িত হয়, কেবলমাত্র তখনই ইতিহাসের নতুন বাঁক সামনে এসে দাঁড়ায়। রোজ রোজ ইতিহাস তৈরি হয় না, রোজ রোজ ইতিহাসের পাতা বদলে যায় না। ১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয়ের ১০০ বছর পরে ১৮৫৭তে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল। ইতিহাস কাঁঠালও নয় যে কিলিয়ে বা কার্বাইড দিয়ে রাখলেই তা পেকে যাবে।