আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমি যে পথ চিনি না। ১৯৬৭-র গান ধীরেন ভট্টাচার্যের লেখা, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছিলেন। ৬৬-র ফেব্রুয়ারিতে বসিরহাট স্বরূপনগরে কংগ্রেসি সরকারের গুলিতে মারা যাচ্ছেন নুরুল ইসলাম, কলকাতার রাজপথে পুলিশ পিটিয়ে মেরেছে কৃষকদের। গান লেখা হচ্ছে শপথ করো শপথ করো দিল প্রাণ বলিদান, বাংলা মায়ের দামাল ছেলে নুরুল ইসলাম। তার পরেও আমরা শুনেছি কংগ্রেসের আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের সময়ে ২১০০ শহীদের কথা। আমাদের রাজপথে ধ্বনিত হয়েছে কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। এখন সেই কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের হাত ধরছে, ধরতে চাইছে। অনেকে অবাক হয়েছেন, বহু কমিউনিস্ট বিপ্লবী ছিছিক্কার করেছেন, এটা কী? কোন ধরনের রাজনীতি? ইত্যাদি প্রশ্ন। অনেকে সিপিএম-এর এই নব অঙ্গীকারকে তাদের বিচ্যুতি হিসেবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সে যাই হোক, ২০১৬ থেকেই আমাদের বাংলায় কংগ্রেস-বাম জোট হয়েছে, খবরের কাগজে ক্যাপশন হয়েছে ৬৭-র গান, আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমি যে পথ চিনি না। সত্যিই মমতা বেরিয়ে যাওয়ার পরে কংগ্রেস নাথবতী অনাথবৎ হয়ে পড়েছে, একথা তো অনস্বীকার্য, কাজেই তারা হাত ধরতে বলবে, কোনও একটা সাহারা চাইবে, এটা তো বাট ন্যাচরাল। কিন্তু এখন সেই গভীর চাহিদা সিপিএম-এরও জন্মেছে, আগেও ছিল, কিন্তু এখনকার মতো এত আকুলি বিকুলি ছিল না। দলের ছোট মেজ সেজ বড়, খোকা এবং জ্যাঠারা গিয়ে হাজির রাহুল গান্ধীর ন্যায় যাত্রায়। শতরূপ থেকে সেলিম রাহুলকে বলেছেন পাপ তো বিদেয় হয়েছে তাহলে এবার যত তাড়াতাড়ি পারা যায় আসন রফাটা সেরে ফেলা যাক, কারণ সেখানেও তো কিছু অসুবিধে আছে। দীপা এবং সেলিমের পছন্দের জায়গা তো একই, ওই রায়গঞ্জ। সে যাই হোক, কমে সমে মিটিয়ে নেওয়া যাবে, এটাও রাহুলকে জানানো হয়েছে, সেটাই বিষয় আজকে। কমরেড সেলিম রাহুল গান্ধীকে বললেন ধরুন হাত।
এই সংসদীয় রাজনীতিতে কোনও রাজনৈতিক দল যে কোনও আরেকটা রাজনৈতিক দলের হাত ধরতেই পারে, ধরেছে, এ তো সব্বার জানা। কংগ্রেস শিবসেনার হাত ধরেছে, নীতীশ লালুর হাত ধরেছেন, ফায়ার ব্র্যান্ড সোশ্যালিস্ট জর্জ ফার্নান্ডেজ বিজেপির হাত ধরেছেন। একই সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে বাম আর বিজেপি। সেখানে সিপিএম কংগ্রেসের হাত ধরতেই পারে। ইন ফ্যাক্ট যদি বিজেপিকে এক চরম ফ্যাসিস্ট শক্তি বলেই চিহ্নিত করা হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে যে কোনও গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ দলের এক প্ল্যাটফর্মে আসা উচিত।
আরও পড়ুন: Aajke | ইট ছুড়ে কারা ভাঙল রাহুল গান্ধীর গাড়ির কাচ?
এখন কী করে বুঝব যে সেই দলটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ? প্রাথমিকভাবে এক রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক ঘোষণায় যা বলছে সেটা মানতেই হবে এবং এটাও দেখতে হবে যে তাদের আচরণে তারা আলাদা কাজ করছে কি না বা তারা আদতে সেই ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরোধিতা করছে কি না। আগমার্কা কোনও ছাপ তো নেই, থাকাও সম্ভব নয়। তো যাই হোক যেভাবে স্তালিন রুজভেল্ট আর চার্চিল হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একে অন্যের হাত ধরেছিলেন সেইভাবে একে অন্যের হাত ধরাই যায়। সেই সূত্র ধরে সেলিমের আমায় হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা বলার মধ্যে কোনও অভিনবত্ব নেই। কিন্তু দ্বিচারিতা আছে। প্রথম দ্বিচারিতা হল সিপিএম দলের কর্মসূচি। সেখানে কংগ্রেস দলের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলা আছে যে এই কংগ্রেস দল হল সিপিএম-এর ভাষায় শ্রেণি শত্রু আধা সামন্ত, আধা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিনিধি। হ্যাঁ, কংগ্রেস সম্পর্কে এটাই সিপিএম-এর বিশ্লেষণ। তাহলে তার সঙ্গে জোট কেন? আপনি বলবেন বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। ঠিক তখনই দ্বিতীয় বিষয়টি এসে হাজির হবে। তাহলে দেশজুড়ে সেই ঐক্য নয় কেন? কেরালা, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, তেলঙ্গানাতে লড়াই আর বাংলা, ত্রিপুরায় ঐক্য কেন? মানে দেশজুড়ে ফ্যাসিস্টরা কি ওই জায়গাগুলোকে ছাড় দিয়েছে? বিজেপি কি কেরালা, রাজস্থান, ছত্তিশগড় বা তেলঙ্গানাতে নেই? হ্যাঁ, এটাই হল দ্বিচারিতা। আর যদি মনেই হয় যে বিজেপির বিরুদ্ধে যারা আছে তাদের সব্বাইয়ের সঙ্গে জোট হবে, তাহলে মমতা সেই তালিকাতে নেই কেন? কোন যুক্তিতে জোটের তালিকাতে নীতীশকে রাখা হয়েছিল? কেবল রাখা নয়, নীতীশকুমারকে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ভাষণ দিতে ডেকেছিলেন এই কমরেড মহম্মদ সেলিম। এটাই তাঁদের দ্বিচারিতা, এইজন্যই তাঁরা এই জোটের সবচেয়ে নড়বড়ে ঘুঁটি। নীতীশ ছিলেন বেরিয়ে গেছেন, মমতা আছেন, বেরিয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু জোটে থেকেই, জোটের কথা বলেই এক রাজ্যে হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা অন্য রাজ্যে কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, এটাই দ্বিচারিতা। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, কমরেড সেলিম কমরেড সুজন রাহুল গান্ধীকে জোট এবং আসন রফা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক সিদ্ধান্তে আসতে অনুরোধ করেছেন, অন্যদিকে কেরালাতে দলের সর্বশক্তি নিয়ে কংগ্রেসকে হারানোর ডাক দিয়েছেন পিনারাই ভিজয়ন। একে কি দ্বিচারিতা বলবেন নাকি আদর্শগত অবস্থান?
সেই মানুষটার কাছে গিয়ে বসলেন কমরেড সেলিম, সুজন, শতরূপ, যাঁর বিরুদ্ধে ক’দিন পরেই কেরালার ওয়াইনাদে সর্বশক্তি নিয়ে নামবে তাঁদের দল, এখানে হাত ধরা ওখানে হাত ভেঙে দেওয়াটা সংসদীয় রাজনীতির খেলাধুলো হতেই পারে, আদর্শগত অবস্থান হতে পারে না আর সেই জন্যই এই দলগুলো বিজেপির ফ্যসিস্ট স্বরূপ, হয় বুঝতে পারেনি, না হলে বুঝেও আসলে সেই ফ্যাসিস্টদের পরোক্ষে সাহায্য করছে।