বিমান বসুকে যদি দশবার জিজ্ঞাসা করা হয় বাম কংগ্রেস জোটের কথা, তাহলে দশবারই উনি বলবেন জোট নয়, বাম কংগ্রেস নির্বাচনী সমঝোতা, এক ধরণের পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার প্রবণতা বিমান বাবুর আজ নয়, বহু পুরনো। সময়ের চাপে পড়ে কংগ্রেস এরসঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রচারে যেতে হচ্ছে, তুলে ধরতে হচ্ছে বিজেপি বিরোধিতার কথা, কিন্তু আশৈশব কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতি করে আসা বিমান বাবু নিজেকেই নিজে সান্তনা দেন, কংগ্রেস বাম জোট হয় নি, নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছে মাত্র, এই বলে। তা দিন কিন্তু এই জোট বা সমঝোতা যাই বলুন না কেন, ভারি গোলমেলে। আসলে সেই বিজেপির উথ্বানের দিনগুলো থেকেই সিপিএম বা বামেদের রাজনীতি এক গোলকধাঁধায় ঢুকে যেতে শুরু করেছিল, এখন তা সেই গোলকধাঁধায় আবদ্ধ। বেরলে বাঘে খাবে, ভেতরে থাকলে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। একগুচ্ছ স্ববিরোধিতা নিয়ে হাসফাঁস করছে এই জোট বা সমঝোতা। প্রথমটা হল বিজেপির উথ্বান সারা দেশে, যদি তাকে রুখতেই হয়, তাহলে সারা দেশ জুড়েই কংগ্রেসের সঙ্গে ওই জোট বা সমঝোতা নয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আছে সিপিএমের কাছে? কেরালায় যদি জোট হয় তাহলে বিজেপিই প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠবে, এটা হল যুক্তি। আজ না হলেও কাল সেটা হবে, আজ খুব সোজা একটা ইস্যুতে, বিজেপিকে রুখতে বিরোধীরা এক হও, যাঁরাই আসবেন, বিজেপির বিরোধিতা করে এক মঞ্চে তাঁরাই স্বাগত, এর বাইরে কোনও কিন্তু যদি আসলে ইত্যাদি দিয়ে বিষয়টাকে গোলালে লাভ বিজেপির, এতটুকু দ্বিধার জায়গাই নেই, বিজেপিকে রুখতে হলে সব্বাই এক হও। তাতেই বিজেপিকে রোখা যাবে কি না জানি না, কিন্তু সেটাই একমাত্র পথ। কিন্তু হাজার একটা স্ববিরোধীতা নিয়েই বিরোধী রাজনীতি গড্ডালিকা প্রবাহের মত চলেছে। গতকাল কেরালার কোঝিকোডে গিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী, বলেছেন আমি টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন আরএসএস – বিজেপির বিরোধিতা করি বলেই আমাকে ইডি ডেকে ৫৫ ঘন্টা জেরা করেছে, কই সিপিএম মূখ্যমন্ত্রী পিনারাই ভিজয়নকে তো করেনি, তাঁকে তো জেলে পোরেনি। অন্যদিকে সিপিএম পলিটব্যুরো নেতা বলেছেন কংগ্রেস আসলে বিজেপিকেই সাহায্য করছে আর তাই এখানে আমাদেরকেই তারা প্রধান শত্রু বলে মনে করে। তিনি কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন এই সিপিএম বা বামেদের মুখোমুখিই মোকাবিলা করতে হবে এবং এসব হয়েছে মাত্র সোমবার সন্ধ্যেতে। এই চুলোচুলির মধ্যে বাংলাতেও জোট, বিমানবাবুর ভাষায় নির্বাচনী সমঝোতা আছে কং বামের, এবং সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, রাহুল গান্ধী বাংলাতে কং – বাম জোটের প্রচারে আসবেন না।
প্রতিটি আঞ্চলিক দল আদতে গড়ে উঠেছে কংগ্রেস বিরোধিতার জায়গা থেকেই, তাদের মূল দ্বন্দ্ব ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে, এই সেদিনও আপ দিল্লিতে এসেছে কংগ্রেসকে সরিয়ে, সমাজবাদী বা এর সঙ্গে জয়প্রকাশ আন্দোলনের লালু মুল্লায়ম নিতীশের সঙ্গে মূল বিরোধ তো ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে। এ রাজ্যে তো কংগ্রেস থেকেই তো বেরিয়ে এসে তৃণমূল হয়েছে। আর আজ সেই আঞ্চলিক দলের প্রত্যেকে লড়ছে কিন্তু বিজেপির সঙ্গে, দারুণ ভাবেই লড়ছে এবং বিজেপিকে হারাচ্ছে। মহারাষ্ট্রে উদ্ধবের শিবসেনা বা শরদ পাওয়ারের এনসিপি লড়ছে তো বিজেপির বিরুদ্ধে, উত্তর প্রদেশের এসপি বা বিহারের আরজেডি লড়াই দিচ্ছে বিজেপি কে, দক্ষিণে স্তালিন লড়ছে বিজেপির বিরুদ্ধে, সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে, ভাষা হেজিমনির বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই, আর এই বাংলাতে বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তৃণমূল ছাড়া এই মূহুর্তে কারোর নেই, গতবার বিধানসভার ফল তা সাফ করে দিয়েছে। কিন্তু কমিউনিস্টরা? তাদের অবশিষ্ট দূর্গে তারা লড়ছে কংগ্রেসের সঙ্গে, এই বাংলাতেও যে এক আধটা আসনে তাদের লড়াই আছে তারমধ্যে অন্যতম মুর্শিদাবাদে তারা লড়ছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তাদের এই স্ববিরোধীতাই তাদের সবথেকে বড় দুর্বলতা। তারা কেরালাতে কংগ্রেসকে বলছে বিজেপির বন্ধু, বিজেপির বি টিম, বলতেই হচ্ছে, তা না হলে কোন ইস্যুতে মুখোমুখি লড়াইটা হবে? অন্যদিকে কংগ্রেসও যা বলছে তা শোনা গ্যালো গতকাল রাহুল গান্ধীর ভাষণে, তিনি সাফ বললেন আপনাদের ইডি ধরছে না কেন? জেলে পুরছে না কেন? বলতে চাইলেন সেটিং আছে। সে চলুক, কিন্তু এটাই যদি প্রচারের রকম সকম হয় তাহলে বাফ জোটের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া রাহুল গান্ধী কি বাংলাতে বাম কং জোট এর পক্ষে প্রচারে আসবেন? কী বলবেন? কেরালার সিপিএম বিজেপির বিটিম আর বাংলার সিপিএম আমাদের বন্ধু, আসুন একসঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করি। পদযাত্রার সময়ে সেলিম নিজের স্বার্থেই মীনাক্ষী, শতরূপদের নিয়ে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে জোটের শিলমোহর চাইছিলেন, উনি জানেন ভাল করেই যে ওই জোট বা সমঝোতা না থাকলে মুর্শিদাবাদে জামানতও বাঁচানো যাবে না, জেতা তো দুরস্থান। তাই উনি গিয়েছিলেন, যেমনটা ওই ফুরফুরা শরিফের ভোট পাবার জন্য আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আপাতত লাখ টাকার প্রশ্ন হল রাহুল গান্ধী আসবেন সমঝোতার পক্ষে কথা বলতে? ভাষণ দিতে? দলের ভেতরের সূত্র বলছে তিনি বাংলা তে আসবেনই না, এলেও কংগ্রেসের এক আধ জন প্রার্থীর পক্ষে ভাষণদিতে আসবেন, তবে তারও সম্ভাবনা কম। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাষা করেছিলাম যে রাহুল গান্ধী কেরালাতে সিপিএম মূখ্যমন্ত্রীকে আসলে বিজেপির বন্ধু বলেছেন, তিনি বলেছেন সিপিএম বিজেপির হয়েই কাজ করছে, অন্যদিকে সিপিএম নেতা মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন বলেছেন সারা দেশে কংগ্রেস আসলে বিজেপির সুবিধে করে দিচ্ছে, তারা নাগরিকত্ব বিলের বিরোধিতাও করেনি। সেই রাহুল গান্ধী এ রাজ্যে বাম-কং জোটের পক্ষে বক্তৃতা দিতে আসবেন? এলে কী বলবেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এরাজ্যে জোট হয়নি বাম বা কংগ্রেসের সঙ্গে এ কথা তৃণমূল নেত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন, তিনি আক্রমণ করেছেন এ রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের, বামেদের, কিন্তু নির্বাচনের পরে ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে থাকবেন তাও সাফ করে দিয়েছেন। যাই হোক একটা স্ট্যান্ড আছে, সেটা জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বামেরা? তাঁরা এ রাজ্যে একরকম, কেরালাতে আর এক রকম, তেলেঙ্গানাতে আরেক রকম, অসমে আরেক রকন অবস্থান নিয়ে চলছেন। বিমানবাবু আসন সমঝোতার আরালে আসলে যে রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে নেমেছেন তার স্বরূপ কিন্তু মানুষ বুঝে ফেলেছে, এর মূল্য চোকাতে হবে, বড় মূল্য দিতে হবে এর জন্য।