বিমান বসু বলেছেন সন্দেশখালি নন্দীগ্রাম নয়, খুব জোর দিয়েই বলেছেন। কারণ নন্দীগ্রাম ওনার মতে কিছুই ছিল না, ছিল কেবল এক গুজব আর মিডিয়ার অপপ্রচার, বিরোধীদের ষড়যন্ত্র। এদিকে শুভেন্দু বলেছেন সন্দেশখালিকে নন্দীগ্রাম বানিয়ে দেব। মানে উনিও জানেন সন্দেশখালি নন্দীগ্রাম নয়, একে নন্দীগ্রাম বানাতে হবে, উনি এবং ওনার দলবল সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মিডিয়ার পণ্ডিতেরা দুইয়ের মধ্যে মিল আর অমিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন আর ভেঁপু মিডিয়া, এই তো নন্দীগ্রাম পেয়েছি বলে উল্লসিত। নির্বাচনের আগে একটা নন্দীগ্রাম পেয়ে গেলে মিডিয়ার উল্লসিত হওয়ার কথা, টিআরপি চড়চড় করে বাড়বে। তৃণমূল অবশ্য ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে, কোথায় চাঁদ আর কোথায়…। সব মিলিয়ে নন্দীগ্রাম যে একটা ব্যাপার ছিল, তা যে ক্ষমতার ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, এবং নন্দীগ্রামের মতো ঘটনা যে ক্ষমতার শক্তপোক্ত ভিতকেও উপড়ে ফেলে দিতে পারে তা নিয়ে সবাই একমত। কাজেই সন্দেশখালি নন্দীগ্রাম হোক না হোক তার প্রচার, তার পারসেপশন রাজ্যের শাসকদলের কাছে যে খুব খারাপ তা নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। সন্দেশখালি শুয়ে থাকা ঘুমন্ত বিবেককেও জাগিয়ে তুলেছে, রাজ্য রাজনীতির ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি হলেন শোভন আর বৈশাখী, তো দুজনেই বলেছেন এ তো জঘন্য ব্যাপার হচ্ছে। বৈশাখী বলেছেন ওনাকেও নাকি নিরামিষ পিঠে নয়, এক্কেবারে মাংস রাঁধতে বলা হয়েছিল, উনি রেঁধেছিলেন কি না তা জানাননি, কিন্তু সময় বুঝে সেই কহানি বলেছেন। একদা বন্ধ ফ্যাক্টরির তামার তার বিক্রি করে সিনেমার টিকিটের খরচ জোগাড় করতেন যিনি, তিনি রাজনীতির এথিকস-এর কথা বলছেন। সব মিলিয়ে সন্দেশখালি একটা ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং একটা কথা তো স্পষ্ট যে এই সন্দেশখালির ঘটনায় কতটা সত্য, কতটা অর্ধসত্য, কতটা বিলকুল মিথ্যে তা হিসেব নিকেশ হওয়ার আগেই শাসকদল যে বড় ধাক্কার মুখে তা তো পরিষ্কার। কে শাহজাহান? কে অজিত মাইতি? কে ওই উত্তম শিবু, আগে তারা যাই থাক, যে দলের আশ্রয়েই থাক, তাদের নেতা শোভন চাটুজ্জে না শুভেন্দু অধিকারী না বালু? সে তর্ক পরে, আপাতত তারা প্রত্যেকে তৃণমূল, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। কাজেই তাদের নেতৃত্বের অপদার্থতা, তাদের ঔদ্ধত্বের জন্য, তাদের অত্যাচারের ফলে কি একটা নন্দীগ্রাম হতে চলেছে? সেটাই বিষয় আজকে। সন্দেশখালি কি নন্দীগ্রাম হয়ে উঠছে?
আসুন আমরা বরং নন্দীগ্রাম আর সন্দেশখালির আলোচনাকে নিয়ে এগোই। সন্দেশখালি তৈরি হয়েছে সন্দেশখালি থেকেই, সেখানের তৃণমূল নেতাদের ঔদ্ধত্বের বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষের একটা বড় অংশ নেমেছে রাস্তায়, সেই শাহজাহান, অজিত মাইতি, শিবু বা উত্তমের সঙ্গে কি মমতা অভিষেকের নাম শোনা যাচ্ছে? নন্দীগ্রাম শুরুই হয়েছিল রাইটার্স থেকে, সিপিএম দলের কার্যালয় থেকে, নন্দীগ্রামের শিরোনামে তো ছিলেন বুদ্ধ ভট্টাচার্য।
আরও পড়ুন: Aajke | সন্তু পান মুক্ত, আমরা খুশি
ভুল না ঠিক তা নিয়ে আলোচনা করছি না, নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সব থেকে বড় মিছিল কি মেদিনীপুরে হয়েছিল? না কলকাতায় হয়েছিল। নন্দীগ্রামের আন্দোলন ছড়াতে মমতা বা তাঁর দলের একজনও জেএনইউতে গিয়েছিলেন? না, বাম ছাত্ররাই সেই ইস্যু জেএনইউতে নিয়ে গিয়েছিল। নন্দীগ্রামে প্রথম ঘটনা ঘটার পরে রাজ্যের সর্বোচ্চ পুলিশকর্তা সেখানে গিয়েছিলেন? ক’জন মন্ত্রী নন্দীগ্রামে গিয়েছিলেন? একজনও নন। হ্যাঁ নন্দীগ্রাম ঘটনা কেবল নয়, ঘটনার পরে তা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রেও নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি ছিল আলাদা। পুলিশ ঢুকতে পারছিল না, গোটা এলাকা মুক্তাঞ্চল হয়ে গিয়েছিল, ভেতরে ঢুকতে হলে বহু কসরত করতে হচ্ছিল ক্ষমতায় থাকা সরকারকে। আর সিপিএম বা সিপিআই দল? তারা ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল। নন্দীগ্রামের লড়াইয়ের ইস্যু জমি, কে কেড়ে নিচ্ছে? স্থানীয় নেতা? কোনও পঞ্চু জগাই? না। মানুষ মনে করেছিলেন সরকার জমি কেড়ে নেবে। আমি ভুল না ঠিক সেই বিতর্কে যাচ্ছিই না, পার্সেপসনটা হল সরকার জমি কেড়ে নেবে, নিচ্ছে। কাজেই তা ছড়িয়ে গেল হু হু করে। এর কোনওটাই সন্দেশখালিতে নেই, কিন্তু সন্দেশখালি কেবল নয় এরকম বহু খালি, বহু পুর, বহু নগরে তৃণমূলের এই খাঞ্জা খাঁরা বসে আছে, বহু জায়গাতেই তাদের অত্যাচার, তাদের লুঠতরাজ সহ্যের বাইরে। সেই জায়গাতে যদি এই আন্দোলনের ছোঁওয়া লাগে, সেখানে যদি আগুন ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সন্দেশখালি নন্দীগ্রাম হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু ঘটনা ঘটার দিন কুড়ি পরেও তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই সন্দেশখালির ঘটনা ওই অঞ্চলে, উত্তর ২৪ পরগনায়, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় খানিকটা হলেও বিজেপির হাত শক্ত করবে। আবার বিজেপি যে ভাবে সন্দেশখালিকে এক মুসলমান অত্যাচারের ন্যারেটিভের দিকে নিয়ে গেছে তাতে মুসলমান ভোটের মেরুকরণ হতে পারে, সে ভোট নিঃসন্দেহে যাবে তৃণমূলের কাছে। কিন্তু এই ক্ষত মেরামত করার সময় পেয়ে গেল তৃণমূল। সংবাদমাধ্যমকে আটকাব, সাংবাদিকদের জেলে পুরব, বিরোধীদের যেতে দেব না ইত্যাদি ভুল না করে তৃণমূল নিজেদের ভুল শুধরোতে পারে, শুধরোবে কি না, শুধরাতে পারল কি না তা তো কিছুদিন পরেই বোঝা যাবে। কিন্তু আর যাই হোক সন্দেশখালি নন্দীগ্রাম হয়ে ওঠার মতো উপাদান জড়ো করতে পারল না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সন্দেশখালিতে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের অত্যাচার, ঔদ্ধত্ব কি আরেক নন্দীগ্রাম হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করল? সন্দেশখালি কি নয়া নন্দীগ্রাম হয়ে উঠতে পারবে? শুনুন কী বলেছেন আমাদের দর্শকেরা।
আসলে জমি অধিগ্রহণ এক বড় ব্যাপার, তা কেবল কোনও একটা রাজ্যের বিষয় নয়। তা কিছুদিন আগে পর্যন্তও সারা বিশ্বে উন্নয়নের চলতি মডেলের সঙ্গে জুড়ে থাকা এক বিষয় ছিল যা নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পরে এক পাকাপোক্ত মূল্যায়নের জায়গায় এল। তা নিয়ে বহু প্রশ্নের বহু জটিলতার এক মীমাংসা এল ওই আন্দোলনের পরে। উন্নয়নের কোনও মডেলেই কৃষকের জমি জোর করে কেড়ে নেওয়ার যাবতীয় পদ্ধতি বন্ধ হল, উঠল উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি। এসবই ছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলনের আফটার এফেক্ট। সন্দেশখালি অবশ্যই তৃণমূল দলের স্থানীয় বা তার উপরের নেতাদের অপদার্থতা, অত্যাচারের ফলেই তৈরি হয়েছে, তা হেলাফেলা করার তো নয়ই বরং এ ধরনের মানুষের অভ্যুত্থান নির্বাচনে বিরাট প্রভাব ফেলতেই পারে, কিন্তু সন্দেশখালি আর যাই হোক নন্দীগ্রাম হয়ে উঠতে পারে না।