তিনি চলে গেছেন একুশ বছর আগে। এ রকমই একটা বাইশে মার্চে। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে তিনি এখনও জীবন্ত। তাঁরই আদর্শে উজ্জীবিত ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে তাঁর জন্ম দিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করত। কিন্তু গত বছর থেকে শুরু হয়েছে তাঁর প্রয়াণবার্ষিকীর উদযাপন। নামে মৃত্যুবার্ষিকী হলেও আসলে দিনটা ছিল পল্টূ দাসের স্মরণে জীবনের উৎসব। এবং তাঁর নামাঙ্কিত দীপকজ্যোতি সম্মান জ্ঞাপন। এ বছর শুধু পাঁচ বিশিষ্ঠ কোচ যাঁদের হাত ধরে উঠে এসেছে ভারতের জার্সি গায়ে দেশে বিদেশে খেলা ফুটবলার এবং ক্রিকেটাররা তাদেরকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি সম্মান জানানো হল পাঁচ উল্লেখযোগ্য শিল্পপতিকে যারা তাদের কর্মক্ষেত্রকে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও নিয়ে গেছেন। এদের সঙ্গে সম্মানিত হলেন শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব, যাঁর সঙ্গে প্রয়াত পল্টূ দাসের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়।
প্রদীপ প্রজ্জ্বলন এবং পল্টূ দাসের ছবিতে পুষ্পার্ঘ্য প্রদানের পরে রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীতে অনুষ্ঠানের সুরটা বেঁধে দেওয়া হয়। ততক্ষণে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রের মূল মঞ্চের সামনে ছোট ছোট টেবলগুলি মানুষে মানুষে ছয়লাপ। পল্টূ দাস নিজে ছিলেন ফুটবলের মানুষ। তাঁর স্মরণ অনুষ্ঠানে চার প্রজন্মের ফুটবলাররা হাজির। ছিলেন সত্তর, আশি, নব্বই এবং নতুন শতকের কিংবদন্তী ফুটবলাররা। তাঁদের প্রায় সবাইকেই সম্মান তুলে দেওয়ার জন্য মঞ্চে আহ্বান করলেন সংযোজক গৌতম ভট্টাচার্য। আক্ষরিক আর্থেই তখন বিকেলটা হয়ে দাঁড়াল এক মিলনমেলা। কে ছিলেন না সেখানে? গৌতম সরকার, সমরেশ চৌধুরি, ভাষ্কর গাঙ্গুলি, অতনু ভট্টাচার্য, কৃষ্ণেন্দু রায়, অলক মুখার্জি, অমিত ভদ্র, বিকাশ পাঁজি, তরুণ দে, দেবাশিস সরকার, সুখেন সেনগুপ্ত, মনোজিৎ দাস, রহিম নবি…। সব মিলিয়ে এক মহামিলন মেলা।
ক্প্রলাব সচিব কল্যাণ মজুমদার এবং ক্রীড়া মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের পরে প্রথমেই সংবর্ধিত হলেন শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব। সংবর্ধনার উত্তরে তিনি বললেন অবিলম্বে শিলিগুড়িতে তিনি শিলিগুড়ি ইস্ট বেঙ্গল কোচিং ক্যাম্প খুলতে চান। এবং তাঁর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরেই দেবব্রত সরকার জানিয়ে দিলেন তাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতার কথা। এর পর পশ্চিম বাংলার পাঁচ শিল্পপতিকে দীপক জ্যোতি সম্মান দেওয়া হল। পেলেন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান ডঃ সুবর্ণ বসু, টেকনো ইন্ডিয়া গ্রূপের কর্ণধার গৌতম রায়চৌধুরি, ডিটিডিসি-র কর্নধার শুভাশিস চক্রবর্তী, শালিমার ওয়ার্কসের চেয়ারম্যান সোমনাথ ভট্টাচার্য এবং মুখরোচক চানাচুরের কর্ণধার প্রণব চন্দকে। শুধু শুভাশিস নিজে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাঁর হয়ে সম্মাননা নিলেন কৌশিক ভট্টাচার্য।
এর পর ছিল তারকাদের যাঁরা তুলে এনেছেন তাঁদের সম্মাননা অনুষ্ঠান। এক তাল মাটি থেকে যাঁরা মুর্তি বানিয়েছেন সেই কোচেদের। সম্মাননা পেলেন মেহতাব হোসেনের কোচ অভী দত্তরায়, সৈয়দ রহিম নবির কোচ মুরারী শূর, অতনু ভট্টাচার্যের কোচ নরেন মজুমদার এবং কৃষ্ণেন্দু রায়ের কোচ শঙ্কর ব্যানার্জিকে। এই কোচেদের সঙ্গে শুধু মেহতাব ছাড়া বাকিদের ছাত্ররা সবাই ছিলেন। শেষ যে কোচকে সংবর্ধনা জানানো হল তিনি ১৯৮৪ সালে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর শিষ্য সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। তিনি এবং বাংলার আর এক অধিনায়ক অরূপ ভট্টাচার্য সম্মাননা তুলে দিলেন কিংবদন্তী কোচ কার্তিক বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র ডঃ সুগতমোহন বসুকে। আর এভাবেই পল্টূ দাসের প্রয়াণ দিবসে একাকার হয়ে গেল ফুটবল ও ক্রিকেট।
এর সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার ছিল। যিনি কোনও দিনও ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলেননি, সেই অকাল প্রয়াত দেবজ্যোতি ঘোষের স্মৃতিতে এক মিনিট নীরবতা পালন হল। আগামি মরসুমে ইস্ট বেঙ্গলের জার্সি গায়ে মাঠে নামার কথা ছিল দেবজ্যোতির। কিন্তু অকাল মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব জানিয়ে দিল, ক্লাবের সঙ্গে তাঁর যে আর্থিক চুক্তি হয়েছিল তা পুরোপুরি বজায় রেখে তাঁর পরিবারের হাতে সেই অর্থ তুলে দেওয়া হবে।
আসলে এটাই হল ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব। মৃত্যুর পরেও তা সঙ্গ রেখে যেতে পারে।