দুবছর ধরে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই চলছে। ৮টি দেশের লড়াই । ফাইনাল নিরপেক্ষ মাঠে হবে, এটা শুরু থেকেই ঠিক ছিল। তাই নাকি ইংল্যান্ডে হচ্ছে এই ফাইনাল। এমন ফাইনাল যার প্রথম দিন টসই করা যায়নি। পরেরদিন খেলা হল ৬৪.৪ ওভার। তৃতীয় দিন খেলা হল – ৬৬.৩ ওভার। চতুর্থ দিন সারাদিনের খেলা আবার বাতিল। খলনায়ক বৃষ্টি আর মন্দ আলো।
টেস্ট ম্যাচের নিয়ম মেনে এই তিনদিন খেলা হওয়ার কথা ছিল ২৭০ ওভার। প্রতিদিনের ৯০ ওভারের হিসেবে। এই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথমদিনের খেলা ভেস্তে যাওয়ার পর ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড ঠিক করেন , প্রতিদিন ৯৮ ওভার করে খেলা হবে। দিনে ৬ ঘণ্টার লড়াই। ম্যাচের চারদিন হয়ে গেল, একদিনও ৬ ঘণ্টা খেলা হয়নি। ৯০ বা ৯৮ ওভার – তার ধরে কাছেও পৌঁছনো যায়নি। কেন? কারণ বৃষ্টি। আর মন্দ আলো।
এই টুর্নামেন্টটি আইসিসির। সকলে প্রশ্ন তুলেছে , আইসিসি কেন এই ফাইনাল ম্যাচ এমন সময় ইংল্যান্ডে আয়োজন করতে গেল? আইসিসি বলছে, করোনা অতিমারিতে এটাই ছিল একমাত্র রাস্তা। আসলে, নিউজিল্যান্ড এই ফাইনালের আগে ইংল্যান্ডে দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে নেমেছিল। তাই কোয়ারানটিনের নিয়ম মেনে ইংল্যান্ডের মাটিতে ম্যাচটি খেলতে সুবিধে ছিল নিউজিল্যান্ডের।
আরও পড়ুন- WTC ফাইনাল: জিতলে ১৭ কোটি টাকা!
মেনে নেওয়া যাক , এটা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু ক্রিকেট মাঠ কি শুধু পিচ নিয়ে খেলা চলে? ২২ গজ ছাড়াও আউটফিল্ডের একটা বড় অংশ জুড়ে খেলাটা চলে। সাদাম্পটনের মাঠে শুধু পিচ আর বোলার রান আপ ঢাকা দেখে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব অবাকই হয়েছে। বাকি মাঠ নিরাবরণ!
বেশ মনে আছে একটা ঘটনার কথা। সি এ বিতে স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় তখন সহ সচিব। আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল ইডেনে। তিনি ঠিক করেছিলেন, গোটা মাঠ ঢাকা হবে বৃষ্টি থেকে মাঠ বাঁচাতে। সেইসময় স্নেহাশিসকে বলতে শুনেছিলাম,’ ইংল্যান্ডের অনেক মাঠে দেখেছি, বৃষ্টি থেকে ম্যাচ বাঁচাতে সারা মাঠ ঢাকা হত। আমরাও সেটাই করে দেখি। ‘ ভাবনাকে বাস্তবে বদলে দিতে বড়বাজার থেকে বড় বড় মাপের প্লাস্টিক ত্রিপল কেনা হয়েছিল। বড় বড় লোহার রড আর ভারী পাইপ দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছিল সেই ত্রিপল। বৃষ্টি হয়েছিল। আবার ম্যাচও হয়েছিল।
স্নেহাশিসের পর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যখন সি এ বির প্রশাসকের আসনে বসেন, তখন ইংল্যান্ড থেকেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পিচ কভার আনিয়েছিলেন। এখন সিএবি গোটা মাঠ ঢেকে রাখতে পারে। মাঠের চারপাশের ড্রেনেজ সিস্টেম সংস্কার করা হয়েছে। বাড়তি সুপার সপার আনা হয়েছে। ইডেনের কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়কে তাই এখন প্রায়ই বলতে শুনি, ‘একটানা বৃষ্টি না হলে ম্যাচ ঠিক হবে। ওভার কমতে পারে। ‘
ইডেন। মনে ভারতের একটি টেস্ট সেন্টার। তাদের পরিকাঠামো এমন বলেই, চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। আইসিসি তো বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা। তারা কেন এভাবে ভাবতে পারেনি ?
আরও পড়ুন – WTC : জেনে নিন ম্যাচের সব নিয়ম
এখন বিজ্ঞান এতোটাই প্রযুক্তির হাত ধরে এগিয়ে গেছে যে, এক মাস আগের অবহাওয়ার আঁচ পাওয়া যায় স্যাটেলাইটের পাঠানো বার্তা থেকে। আইসিসি নিশ্চয়ই তা নেয়নি। নাহ, আঁচ পেয়েছিল। তাই তো রিজার্ভ ডে রেখেছিল। কিন্তু এমন হাল হবে জানা নাকি ছিল না।
আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে নানান ছবি দেখেছি এই এজেস বোল স্টেডিয়ামের । দেখেছি প্রথমদিনের টি টাইমে মাঠের একদিক জল জমে ছোটো ডোবা হয়ে গিয়েছিল। দেখেছি মাঠের ধরে সুপার সপার চলছে। আর মাঠের জল, সেই যন্ত্রের পাইপ দিয়ে যেন শহর কলকাতার রাস্তায় লাগানো কলবিহীন গঙ্গা জলের গতিতে গল গল করে বেড়িয়ে আসছে।
আকাশ মেঘে ঢাকা। রোদ্দুরের দেখা নেই। মাঠ জল মুক্ত হলেও আউটফিল্ড ভিজে। মাটি নরম। ফিল্ডিংয়ের অনুপযুক্ত। এই স্টেডিয়াম ফ্লাড লাইট আছে। কিন্তু ইডেনের মত হাজার হাজার ওয়াটের নয়। ফলে তা জ্বালিয়ে মাঠ শুকনো যায় না। দর্শকদের স্বাচ্ছন্দ্য নেই। গ্যালারির উপর আচ্ছাদন নেই। দর্শকদের ভিজতেই হবে! আইসিসি কেন এমন মাঠে খেলা রেখেছে!
আই সি সির হাতে আর কী কী করার সুযোগ ছিল? গত দেড় বছর ধরে করোনা গোটা বিশ্বের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তারই মধ্যে কিন্তু ক্রিকেট চলেছে। তাহলে কেন আইসিসি অনেক সময় পেয়ে এমন নিরপেক্ষ দেশ বাছেনি, যেখানে এই সময় বৃষ্টি মাথাব্যাথার কারণ হত না। নিরপেক্ষ দেশ মানেই তো শুধু ইংল্যান্ডই নয়।
জুন মাস আর ইংল্যান্ড মানেই তো বৃষ্টি। আইসিসি’র সদর দপ্তর এখন দুবাইয়ে। সেখানে আইসিসির নিজস্ব পরিকাঠামো খুব ভালো। এই মরু দেশে গতবার গোটা আইপিএল আয়োজন করে ভারতীয় বোর্ড দেখিয়ে দিয়েছিল সাংগঠনিক দক্ষতা। কোরোনা আতিমারির মধ্যে নির্বিঘ্নে টুর্নামেন্ট শেষ হয়েছিল। এখন এই মরু শহরে চলছে, পাকিস্তান সুপার লিগের খেলা। বৃষ্টিতে একটাও ম্যাচ ভেস্তে যায়নি। তাহলে অনেক আগে থেকে আইসিসি এখানে ফাইনাল করার উদ্যোগ নেয়নি কেন ? যে দলই খেলত, নিরপেক্ষ মাঠই তো হত।
এবার ফাইনাল নিয়ে দুটি কথা লিখি। একটা টুর্নামেন্ট যখন লিগভিত্তিতে খেলা হয়, তখন সব দেশেরই সমান সমান ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া উচিত। পরিসংখ্যান বলছে, ফাইনালে খেলা ভারত খেলেছে ২২ টি ম্যাচ। আর সেখানে নিউজিল্যান্ড ১১ টি! এ আবার কেমন টুর্নামেন্ট! ভারত – অস্ট্রেলিয়া , ভারত – ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া – ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া – দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান – ইংল্যান্ড , পাকিস্তান – নিউজিল্যান্ড এইসব সিরিজ কটা করে ম্যাচের হল? কোনটায় ৫ ম্যাচের সিরিজ, কোনটায় ৪ কিম্বা তিন। কেন এটা হবে না, সিরিজে যে কটা ম্যাচের হয় হোক– তিনটে করে ম্যাচ নির্দিষ্ট থাকা উচিত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য। এই তিন ম্যাচের পয়েন্ট বিবেচ্য হবে। হল কই! ভারত – বাংলাদেশ আর ভারত – অস্ট্রেলিয়া সিরিজ এক দাড়িপাল্লা মাপা যায়!
এই ফাইনাল বৃষ্টির জলে ভাসছে। ভারতের জাতীয় ক্রিকেট সংস্থা আজ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী সংস্থা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল জিতলে ১৭ কোটি টাকা পাওয়াটা বলা যায় বিসিসিআইয়ের কাছে নস্যি। কিন্তু সম্মানটা? বিশাল। আর নিউজিল্যান্ডের কাছে বিশ্ব সেরা হয়ে ১৭ কোটি টাকা পুরস্কার অর্থ পাওয়া – এক বিরাট পাওনা। নিউজিল্যান্ড এই ম্যাচে এখনও পর্যন্ত চালকের আসনে। ভারত প্রথম ইনিংস শেষ করেছে। নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংস খলেছে। ৪০ ওভার খেলার মাঝে ২ উইকেট খুয়ে তিন অঙ্কের রানের গন্ডিতে ঢুকে পড়েছে। এই ম্যাচের শেষদিন মঙ্গলবার -২২ জুন।
বৃষ্টি রেহাই দেবে মঙ্গলকে, এমন ইঙ্গিত এখনও নেই। তাই কাল টপকে বুধবার রিজার্ভ ডে তে খেলা গড়িয়ে যাবে। কিন্তু দুই দলের একটা করে ইনিংস শেষ হবে কি? আইসিসি এই ফাইনালে ‘ড্র’ সিস্টেম রেখেছে। যেমন যে কোনো টেস্টেই হয়। কিন্তু এমন এক টুর্নামেন্ট চালিয়ে, একটা ম্যাচেই ফাইনাল দিয়ে বিশ্বসেরার বিচার! ভারতীয় হেড কোচ রবি শাস্ত্রী কিছু ভুল প্রস্তাব দেননি। ‘ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল হওয়া উচিত তিন টেস্টের সিরিজ।’ আইসিসি , ভেবে দেখুন – বাড়তি দুটো ম্যাচ মিলবে। অর্থ তো মিলবেই। ক্রিকেটও মিলবে।
ছবি: সৌ – টুইটার।