এই বিশ্বে মানুষের তৈরি এমন অনেক কিছু আছে যা বিস্ময়কর একই সঙ্গে ভয়ানক। তার মধ্যে এমন অনেক রাস্তা আছে যা বিশেষ কিছু বিষয়ের জন্য বিখ্যাত। তাহলে চলুন হাড়ের রাস্তা, বিশ্বের সবচেয়ে ঠান্ডা রাস্তায় একটা ট্রিপ আপনার জন্য। কোথাও মাথার খুলি, কোথাও বা হাত-পা বা শরীরের অন্য অংশের হাড়ের টুকরো প্রায় গোটা রাস্তাতেই ছড়িয়ে রয়েছে। রাশিয়ার উত্তর পুর্বে সাইবেরিয়ার ইয়াকুটস্কের নিকটবর্তী এক হাইওয়ের মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। জানেন এই রাস্তাকে কি বলা হয়। শুনলে চোখ কপালে উঠবে। রাস্তার নাম ‘রোড অব বোনস’। অবশ্য এর একটি পোশাকি নামও রয়েছে— আর৫০৪ কোলাইমা হাইওয়ে।
রাশিয়ার সুদুর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এই রাস্তাটি আসলে একটি হাইওয়ে। এই সড়কের আসল নাম কোলিমা হাইওয়ে (Kolima Highway)। এটির দৈর্ঘ্য ২,০২৫ কিলোমিটার। এই মহাসড়কে প্রায় মানুষের হাড় ও কঙ্কাল পাওয়া যায়। ‘হাড়ের রাস্তা” নামে পরিচিত এই সড়কের গল্পটা একটু অন্যরকম। শীতের মরশুমে এই এলাকায় প্রচন্ড তুষারপাত (snowfall) হয়, ফলে রাস্তা ঢেকে যায়। বলা হয় তুষারপাতের কারণে যানবাহন পিছিলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সেই কারণে রাস্তা নির্মাণে বালির সঙ্গে মানুষের হাড়ও মেশানো হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বৈরশাসক জোসেফ স্ট্যালিনের (Joseph Stalin) সময় এই মহাসড়কটি নির্মিত হয়েছিল। কোলিমা সড়ক তৈরিতে প্রাণ হারায় আড়াই লাখ মানুষ। এই সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৩০ এর দশকে, যেখানে বন্ডেড শ্রমিক ও বন্দীদের নিযুক্ত করা হয়েছিল। এই শ্রমিকদের কোলিমা ক্যাম্পে বন্দী হিসেবে রাখা হত।
অনুমান করা হয়, এই পথ তৈরি করতে গিয়ে বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন। তাদের হাড় এই রাস্তার নীচেই চাপা পড়ে যায়। মূলত যারা কাজ করার সময় মারা যেতেন তাদের রাস্তায়ই মাটি চাপা দেয়া হত। গ্রীষ্মে এই অঞ্চলটি আর্দ্র এবং অস্বাস্থ্যকর। শীতকালে অসম্ভব ঠান্ডার কারণেও এখানে তেমন ভাবে মানব বসতি গড়ে তোলা যায়নি। এই দুর্গম জায়গাতেই গুলাগে আটক মানুষদের দিয়ে তৈরি করা হয় এই হাইওয়ে। সেই কারণে এই রাজপথ আজ সোভিয়েত জমানার এক লজ্জাজনক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিবেচিত। স্তালিন আমলের গুলাগে আটক মানুষের জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মারক এই পথ আজ যেন এক জীবন্ত মিউজিয়াম। কোলাইমা অঞ্চলের গুলাগে বন্দি ছিলেন কবি ভারলাম শালামভ। মুক্তি পাওয়ার ১৫ বছর পরে তিনি সেই বন্দিজীবনের স্মৃতিকথা ধরে রাখেন ‘কোলাইমা টেলস’ নামক গ্রন্থে।
আরও পড়ুন: Vintage Rotary Phone । প্রিয় মানুষকে বলা হয়ে ওঠেনি মনের কথা? নির্জন জঙ্গলে রয়েছে ভিনটেজ ফোন
শালামভের স্মৃতিকথাকেও অনেকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। আজকের স্তালিনভক্তরা তাকে আগাগোড়া কল্পিত বলে দাবি করেন। রাশিয়ার উত্তর পূর্বের শহর মাগাডানের সঙ্গে লেনা নদীর তীরে নিঝনি বেস্টিয়াখ শহরকে সংযুক্ত করেছে ‘রোড অব বোনস’। গুলাগের ভয়াবহতাকে গণস্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য মাগাডানে রয়েছে একটি গুলাগ মিউজিয়াম। ১৯৯০ সালের দশকে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের আমলে ‘রোড অব বোনস’এর মুখেই তৈরি করা হয় ‘মাস্ক অব সরো’ নামের একটি কংক্রিট ভাস্কর্য। কোলাইমার অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতের স্মারক এই ভাস্কর্য।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ স্থায়ীত্ব ছিল চার বছর। যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ। তখনও বাতাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বারুদের গন্ধ, প্রিয়জনকে হারানোর ক্ষত না সারতেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ক্ষমতার লড়াই সীমাবদ্ধ থাকেনি রাজাদের মধ্যে। যুদ্ধের বিষ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বেই। এই সময় অনেক দেশ এবং শহর হয়েছে নিশ্চিহ্ন। তেমনই ভলগার তীরঘেঁষা ঐতিহাসিক স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ, যা থামিয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয় সভ্যতার পতন। ১৯৪৩ সালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী প্রায় পুরো ইউরোপ দখল করে। তারও আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের ককেশাস অঞ্চল দিয়ে এগিয়ে মস্কো দখলের অভিপ্রায়ে স্তালিনগ্রাদ শহরকে কবজায় আনতে চেয়েছিল। সাড়ে ছয় মাস ধরে স্তালিনগ্রাদ শহর ঘিরে চলা এই যুদ্ধ ছিল নৃশংস আর ভয়াবহ। সময়কার ভয়াবহ আর নারকীয় হত্যার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক শহর। তেমনি রাশিয়ার উত্তর পূর্বে সাইবেরিয়ার ইয়াকুটস্কের নিকটবর্তী এক হাইওয়ের যেখানে সেখানে মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। সম্প্রতি আবার গুলাগের ভয়াবহতাকে উস্কে দিয়েছে ‘রোড অব বোনস’থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু নরকঙ্কাল। অনুমান, ১৯১৭-১৯২২ সালের রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে মৃত ব্যক্তিদের কঙ্কাল সেগুলি। এই অঞ্চলের মাটির নীচে রয়ে গিয়েছে রুশ ইতিহাসের আর এক রক্তক্ষয়ী সময়ের ইতিহাসও। সব মিলিয়ে, ‘রোড অব বোনস’ সোভিয়েত নির্যাতনের এক বহমান স্মারক।