আমরা দেখেছি পুলিশকে ঘুষ নিতে, প্রকাশ্য রাস্তায়, আমরা দেখেছি পুলিশকে পথচারী বৃদ্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিতে। আমরা দেখেছি পুলিশকে নির্মমভাবে লাঠি পেটাতে, আমরা দেখেছি পুলিশকে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে বাইকে চাপিয়ে সময়ে পরীক্ষা হলে পৌঁছে দিতে। তাদের দেখেছি পূজোর উৎসবের দিনগুলোতে টানা ডিউটি করতে, দেখেছি নির্লজ্জের মতো পয়সাওলা মানুষের হয়ে দালালি করতে। এ সবই পুলিশের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রূপ। সেই পুলিশকেই দেখা গেল এক কিশোরীর নগ্ন দেহ রাস্তা দিয়ে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে যেতে। সে নৃশংস ছবি ইতিমধ্যেই ভাইরাল। কেন এমনটা ওনারা করলেন? এক কিশোরীর মৃতদেহ পড়েছিল, পুলিশ খবর পায়। ৫ ঘণ্টা পরে সেখানে যায়, ততক্ষণে গুজব ছড়িয়েছে নানান রকম, ততক্ষণে কান্নার রোল ছড়িয়েছে, ততক্ষণে বিচারের দাবি উঠেছে, সবচেয়ে বড়কথা ততক্ষণে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে এসে গেছে লাভ জেহাদের তত্ত্ব, কেমনভাবে পরিকল্পনা করে হিন্দু মহিলাদের সম্ভ্রম লুঠ করার জন্য সংখ্যালঘু মুসলমানেরা লাভ জেহাদ ঘোষণা করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা। অতএব পুলিশ যেতেই মানুষের উত্তেজনা শুরু, পুলিশ যে উত্তেজনা না থামিয়েই মৃতদেহ তুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করে, পুলিশ মৃতদেহ নিয়ে কোনওরকমে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়চ্ছে, পেছনে উত্তেজিত জনতা। এক মৃতদেহকে সরিয়ে নিয়ে আসতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে আনার ঝুঁকি নিতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু প্রশ্ন তো থাকবেই। কেন পুলিশ আগে খবর পেল না? কেন ৫ ঘণ্টা পরে গিয়ে হাজির হল? কেন উত্তেজনা না থামিয়েই কোনও রকমে মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল পুলিশ? পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের কি কোনও রকম যোগাযোগ নেই? সিভিক পুলিশরা কী করছিল? এবং সেই উত্তেজনা থামার আগেই পুড়ে ছাই কালিয়াগঞ্জ থানা। আজ সেই কালিয়াগঞ্জই বিষয় আজকে। কালিয়াগঞ্জের পুলিশ।
আইপিএস পুলিশ অফিসার দেখেছেন? আইএএস অফিসারের বাংলোতে গেছেন? মন্ত্রী ছেড়েই দিন, শাসকদলের জেলার নেতাদের দেখেছেন? আগে পিছনে পুলিশ। আমি আইপিএস অফিসারের বাচ্চা মেয়েকে পুলিশের পিঠে দেখেছি, সে পুলিশ তখন মন দিয়ে ঘোড়ার অভিনয় করছিলেন। যে কোনও উদ্বোধন অনুষ্ঠানে চলে যান, মুখ্যমন্ত্রী থেকে পঞ্চায়েত প্রধান, উদ্বোধক যে কেউ হতে পারে, গুরুত্ব অনুযায়ী সেখানে হাজির থাকবে গন্ডায় গন্ডায় পুলিশ। শাসকদল বা বিরোধী দলের যে কোনও মিছিলে মিটিংয়ে শয়ে শয়ে পুলিশ। কাজেই পুলিশ ব্যস্ত হয় রাজনৈতিক, বা অন্য ভিভিআইপিদের পাহারা দিতে, না হলে এসপি, ডিএমদের ফাই ফরমাশ খাটতে। এরপরে যারা বাকি তারা সক্কাল থেকে জেনারেল ডায়রি, এফআইআর নিতে, তার উপরে রয়েছে উপরওলার হুমকি, পাড়ার নেতাদের চোখরাঙানি। কাজেই তাদের সময় কোথায় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার। পুলিশ জনবিচ্ছিন্ন, পুলিশের কাজও জনবিচ্ছিন্ন কাজেই ওয়ান ফাইন মর্নিং যা ঘটে গেল তার থই পেতে, সে ঘটনা সামলাতে সে নাজেহাল। পুলিশ আর এলাকার মানুষ, পুলিশ আর নাগরিক সম্পর্কটা ঠিক কেমন হওয়া উচিত? তা নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই, নাগরিক আইন মেনে চলবে, পুলিশ আইন শৃঙ্খলা শান্তি বজায় রাখবে। তার বদলে একজন আম জনতা পুলিশের কী ভূমিকা দেখে? পুলিশ মানেই উটকো ঝামেলা, ব্রিটিশের সময়ে প্রবাদ, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, সে তো এখনও একই রকম রয়ে গেছে। পুলিশকে কিছু মানুষ ভয় করে, কিছু মানুষ পাত্তাও দেয় না আর বেশিরভাগ মানুষের সাধারণ ধারণা হল পুলিশ এক সংগঠিত মাফিয়া, সংগঠিত গুন্ডা। কাজেই পুলিশকে এড়িয়ে চলো, কিন্তু যেদিন সুযোগ পাবে মানুষ, সেদিন পেটাবে, যেমন করে পেটায় পুলিশ, এটাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে, পুলিশ কখনও চেয়ারের তলায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে, কখনও হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে, আর মেরো না আর মেরো না বলে চিৎকার করছে। এতটা অসহায় পুলিশ কবে থেকে হল? কীভাবে হল? আলোচনা করব, তার আগে আসুন জেনে নিই পুলিশ কি সত্যিই অসহায়? পুলিশ কে কি কাজ করতে দেওয়া হয় না? পুলিশি কাঠামো কি ভেঙে পড়েছে? কী বলছেন মানুষজন?
আরও পড়ুন: Aajke | নবজোয়ারের গল্প
আসুন একবার ক্রোনোলজিটা বোঝা যাক। কালিয়াগঞ্জে একটি মেয়ের মৃত্যু, তাকে ঘিরে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে গেল যে পুলিশকে মেয়েটির মৃতদেহ নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে পাইলিয়ে আসতে হল, পরদিন এটাই খবরের কাগজের হেডলাইন। পুলিশের নৃশংসভাবে মৃতদেহ নিয়ে আসার ভিডিয়ো ভাইরাল, এলাকায় উত্তেজনা। নিশ্চয়ই জেলা সদর থেকে পুলিশকর্তারা গেছেন, নিশ্চয়ই আরও পুলিশ মোতায়েন হয়েছে। সেই সংখ্যা কত হবে? আমাদের হিসেব বলছে খুব কম করে হলেও ৫০-৬০ জনের?মতো অস্ত্র হাতে পুলিশ উপস্থিত ছিল। এরপরেও মানুষ এসেছে, থানার সামনে সার করে রাখা বাজেয়াপ্ত গাড়ি পুড়িয়েছে। তারপর থানা পুড়িয়েছে। পুলিশকে নির্মমভাবে পেটানোর ছবিও ভাইরাল। গুলি চলেনি, ভালো কথা, চললে এ উত্তেজনা আরও বাড়ত, কিন্তু খতিয়ে দেখার সময় তো এসেছে যে পুলিশ ঘটনার সামনে পড়েই বার বার এত অসহায় হয়ে পড়ছে কেন? পুলিশের সঙ্গে মানুষের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কেন? এবং আরও জরুরি প্রশ্ন, এই ক’দিনের ঘটনায় যাঁরা পিছন থেকে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা কারা? তাঁদের পরিচয় কী?