ছড়িয়ে একশো বলে একটা কথা আছে না, ভবানীপুরে নির্বাচন ঘোষণার পর রাজ্যের বিরোধী দলগুলোকে দেখে সেটাই মনে হচ্ছে, ছড়িয়ে একশো। ভবানীপুরে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রার্থী দিতে নারাজ অধীর, রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি, ওদিকে সামসেরগঞ্জে গতবারের কংগ্রেস প্রার্থী জানিয়েছেন, তাঁর অনেক কাজ আছে, তাছাড়া তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যের মানুষের জন্য কাজ নিয়ে খুশি, তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। ওদিকে একলা জগাই সিপিএম, তাদের মুখপত্রে প্রথম পাতায়, সংযুক্ত মোর্চাকে জয়ী করার আহ্বান জানিয়েছে, যে সঙ্গযুক্ত মোর্চার অন্যতম নেতা অধীর চৌধুরি জানিয়েছেন, মমতার বিরুদ্ধে প্রার্থী দিতে তিনি ইচ্ছুক নন। আর বিজেপি রোজ একটা করে উইকেট খুইয়ে বিপর্যস্ত, আপাতত আদালতে গিয়ে নির্বাচন বাতিল করার চেষ্টায় নেমেছে জানা নেই তাদের হয়ে সামলা পরে, কমরেড বিকাশ ভট্টাচার্য নামবেন কিনা, তবে তাঁরা নির্বাচন লড়ার চেয়ে সহজ উপায়, নির্বাচন বাতিল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। নজর রেখেছেন দলে দমবন্ধ হওয়া বিধায়ক তালিকার দিকে, কারণ এমন চলতে থাকলে কিছুদিন পরে বিরোধী দলনেতার পদটা সম্ভবত হাতছাড়া হবে, এটা কাঁথির খোকাবাবু জানেন, দিলীপ ঘোষও জানেন। এখনও তাঁদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা হয়নি কিন্তু সাতে পাঁচে থাকি না দাদা, রুদ্রনীল ঘোষ জানিয়েছেন, তিনি প্রার্থী হতেই পারেন, যদি দল চান। এখানেই থামেননি, তিনি তারপর জানিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর মিল আছে, তিনিও নির্বাচনে হেরেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হেরেছেন। ওনার কথায় ‘দুই হেরো প্রার্থী’র মধ্যে লড়াই হবে। কখনও সখনও রামছাগলেরও দাড়ি আছে, রবি ঠাকুরেরও দাড়ি আছে গোত্রের ভাঁড়ামো আমরা শুনি, যে ভাঁড়ামোর জন্য রুদ্রনীল আমাদের সমাজে পরিচিত। এই রুদ্রনীল কলেজে এসএফআই করতো, তারপর টালিগঞ্জ, নাটকের মঞ্চেও বহুদিন দেখা গেছে। সেই বুদ্ধ বাবুর আমলে এক মহিলার শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠায়, রুদ্রনীলকে গ্রেফতার করতে পুলিশ গিয়েছিল আকাদেমিতে, তখন ভেতরে নাটক চলছে, অভূতপূর্ব ঘটনা। তারপর সেই অভিযোগ ম্যানেজ করা হয়। উনি আরও মন দিয়ে সিপিএম করতে থাকেন, সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্যায়ে ভয়ঙ্কর মমতা বিরোধী রুদ্রনীল, হঠাৎই পালাবদলের কিছুদিন পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে মাতৃরূপ খুঁজে পান, নরেন্দ্র মোদি যে দেশটাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাচ্ছে, সে নিয়েও সরব হতে থাকেন। দক্ষিণেশ্বরে, মদন মিত্রের ফ্ল্যাটে আর কালিঘাটে নিয়মিত আনাগোনা বাড়াতে থাকেন, এবং শেষমেষ নেত্রীর দয়ায় নীলগাড়ি আর মাসোহারার ব্যবস্থা করেও ফেলেন। এবার কেন্দ্রে পালাবদল শুধু নয়, রাজ্যে ১৮ জন সাংসদ বিজেপির, তিনি মনে করলেন, আরও বড় খেলা শুরু করাই যায়, সম্ভবত তথ্য সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী হবার সাধ ছিল, নির্বাচনের আগে দিল্লিতে দলবদল সেরে চার্টার্ড ফ্লাইটে ফিরলেন কলকাতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ততদিনে আর মা নন, বাংলার সর্বনাশ ডেকে আনা এক দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেওয়া মুখ্যমন্ত্রী। তো তিনি দাঁড়ালেন এবং প্রায় ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারলেন। গতবার তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছিলেন ৪৭.৬৭ ভোট, এবার শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় পেলেন ৫৭.৭১% ভোট। সিপিএম থেকে তৃণমূল হয়ে বিজেপি প্রার্থী রুদ্র হারলেন। টলিউডের অনেকেই রুদ্রনীলের ওপর ভরসা করে, নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসরে নেমেছিলেন, রাজনীতি নিয়ে তারা রুদ্রনীলের মতই নাদান, পায়েল, অঞ্জনা, তনুশ্রী, শ্রাবন্তী ইত্যাদিরাও হেরেছেন, হেরে বুঝেছেন রাজনীতিটা তাঁদেরর বিষয় নয় তাঁরা একে একে সরে গেছেন, আপাতত দেশসেবা, সমাজসেবা ইত্যাদি ছেড়ে মন দিয়েছেন ক্যামেরার সামনে, যাঁরা নির্বাচনে ছিলেন না, সেই কাঞ্চনা, অনিন্দ্যপুলক, রিমঝিম ইত্যাদিরা ও তাঁদের রাজনৈতিক বালখিল্যপনা বুঝে, নিজেদের কাজে মন দিয়েছেন, এটাও স্বাভাবিক। একটা হুজুক তুলেছিল কিছু মানুষজন, মিডিয়া, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা, এবার আসছে বিজেপির সরকার, তো সেই হুজুকে মেতেছিলেন অনেকেই, রাজনীতির লোকজন দল পালটে আবার যে যার ঘরে, আর অরাজনৈতিক শিল্পী ইত্যাদিরা নিজেদের কাজে, মদন মিত্রের পার্টিতে, ও লাভলি। খুব স্বাভাবিক।
কিন্তু রুদ্রবাবু জানেন, যতটা বেড়ে খেলেছেন, তাতে তাঁকে ওই অমিত শাহ, শুভেন্দুকে ধরেই বাঁচতে হবে, তাই মাঠে আছেন, নিজেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমকক্ষ করে তোলার অবিমৃষ্যকারিতা নিয়ে, হাস্যকর ভাঁড়ামো নিয়ে, তিনি ভেসে থাকতে চাইছেন।
এবার আসুন এই সাতে পাঁচে থাকি না দাদা, যাঁর সমকক্ষ হতে চাইছেন, একবার তাঁর রাজনৈতিক জীবনটা দেখা যাক। না না, তিনি ক’বার এমপি হয়েছেন, কতবার কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছেন, পাঁচবছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, এসব পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, একটু অন্য জায়গা থেকে দেখার চেষ্টা করা যাক। রাজনীতিতে সেই মানুষজন থেকে যান, মানুষের মনে, রাজনৈতিক ইতিহাসে, দেশের ইতিহাসে, যাঁদের জীবনের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক সামাজিক অধ্যায় জুড়ে যায়, মানুষ, দেশের ইতিহাস তাঁদেরকে সেই কারণেই মনে রাখে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, স্টেটসম্যান হিসেবে। যেভাবে মানুষ জওহরলাল নেহেরু, মোরারজী দেশাই, জর্জ ফার্ণান্ডেজ, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, অটল বিহারী বাজপেয়ী, এল কে আদবানি, জ্যোতি বসুকে মনে রাখেন, সেইভাবেই ইতিহাসে থেকে যাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তাঁর প্রথম নির্বাচনে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়েছিলেন, এটা বড় কথা নয়, এমন জায়েন্ট কিলার তো রাজনারায়ণও ছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীকে হারিয়েছিলেন, ক’জন আর তাঁকে মনে রেখেছে? আসুন সেই ইতিহাসটা একটু দেখা যাক।
১৯৯০, টি এন শেসন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এসেছেন, এসেই ভোটার আইডির কথা বললেন। জ্যোতি বসু তাঁকে বলেছিলেন, মেগালোম্যানিয়াক। সিপিএম কর্মীরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যঙ্গ করছেন, যে চাষার ঘরে খড়ের ছাদ দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ে, সে কোথায় রাখবে তাঁর ভোটার কার্ড? সেই তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন নো ভোটার কার্ড, নো ভোট। ভোটার কার্ড বাধ্যতামূলক করতে হবে, ২১ জুলাই বাংলার যুব কংগ্রেসের ডাকে রাইটার্স অবরোধ, ইতিহাস সবার জানা। যারা হেঁসেছিল সেদিন তাঁরাও আজ হাতে ভোটার কার্ড নিয়েই ভোট দিতে যান। এটা হল স্টেটসম্যানশিপ। সেদিন সারা দেশের মানুষ জেনেছিল ভোটার কার্ডের জন্য লড়ছেন মমতা। আজ সারা দেশের মানুষ ভোটার কার্ড নিয়েই বুথে যান, সেই অধিকার আর ইতিহাস টি এন শেসন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে লেখা যাবে না। রুদ্রনীলের ইতিহাস, আকাদেমিতে পুলিশ এড়িয়ে গ্রেফতারি বাঁচানোর, আজ তিনি সমকক্ষ হতে চাইছেন, একে আবালপনা বলে।
আসুন পরের ইতিহাসে, কৃষকদের জমি কেড়ে নিয়ে শিল্প হবে, আধুনিক স্যাটেলাইট সিটি তৈরি হবে, যখন খুশি, যখন ইচ্ছে। এটাই ছিল নিয়ম। সেই নিয়মেই সিঙ্গুরের চারফসলি জমি অধিগ্রহণ করে, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের হোতা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই জমি টাটার হাতে তুলে দিলেন, আন্দোলন হয়েছিল, অনেকে ছিলেন, কিন্তু সামনের মুখ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই লড়াইয়ে হেরেছিল রাজ্য সরকার, সেই লড়াইয়ের ফলশ্রুতিই ৩৪ বছরের বাম দূর্গের পতন। কিন্তু সেটাই সব নয়, কৃষি জমি অধিগ্রহণের আইন বদলে গেলো, কেবল এদেশে নয়, জোর করে কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে উন্নয়নের গল্প বলা বন্ধ হল দেশের বাইরেও, রেফারেন্স? সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই, এটাই স্টেটসম্যানশিপ। এরজন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে যাবেন ইতিহাসে, রুদ্রনীল থাকবেন মমতার মধ্যে মাতৃরূপ দেখার পরে, সম্ভবত নরেন্দ্র মোদির মধ্যে পিতৃরূপ খুঁজে পাবার ইতিহাসে, সমকক্ষ হবার ভাঁড়ামি নিয়ে। এরপর দ্বিতীয় তৃণমূল সরকার, আসার আগেই শোনা যাচ্ছিল, আসার পরে প্রকল্প এল, দুয়ারে সরকার, ১৯৭৭ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, আমরা রাইটার্স থেকে নয়, মানুষের মধ্যে থেকে সরকার চালাবো, পারেননি। মমতা সেটাই করে দেখালেন, তিনি এরপর থাকুন, না থাকুন, তাঁর দল ক্ষমতায় থাকুক আর না থাকুক, দুয়ারে সরকার পার্টিসিপেটরি ডেমক্রেসির চেহারা নিয়ে থেকে যাবে শুধু নয়, তার শেকড় আরও গভীরে যাবে, মানুষ দুয়ারে সরকারের আসাটা কারোর দয়ার দান নয়, অধিকার হিসেবেই দেখবে। কারোর ক্ষমতা হবে না এই অধিকার ছিনিয়ে নেবার, দেশের অন্যত্র তা ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারির রাজনীতি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগেও দেশে ছিল, কিন্তু দুয়ারে সরকার এক অন্য অধিকারের কথা বলে, সরকারের আমলা, রাজনৈতিক নেতা, বিধায়ক এসে হাজির হবে পঞ্চায়েতে, সেখানে মানুষ জড় হয়ে তাঁদের সরকারি প্রকল্পের অধিকারের কথা বলবে, এ কি কম বড় কথা। এই ইতিহাসের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের নাম মনে রাখবে মানুষ, নিশ্চই কখনও সখনও মনে আসবে সাতে পাঁচে থাকি না দাদার নাম, তবে সেটা ইতিহাসের এক ভাঁড় চরিত্র হিসেবে, এক পাল্টিবাজ ধান্ধাবাজ মানুষ হিসেব, অবশ্য এমন চাহিদাও তো কারোর কারোর থাকে।
চার্লস শোভরাজ শেষবার ধরা পড়ার পর বলেছিল, আমি ক্রাইম ওয়ার্ল্ডে তিহার জেল ভেঙে বের হবার জন্যই অমর হয়ে থাকবো। এমন ইচ্ছে তো থাকতেই পারে। রুদ্রনীলের সে ইচ্ছে সফল হোক, তিনি রাজনৈতিক ভাঁড় হিসেবে অমর হয়ে থাকুন।