সোমবার দেশের ১২টা বিরোধী দল, তাদের নেতারা মিলে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রার্থীর নমিনেশন দাখিল করলেন৷ তার আগে তৃণমূল দলের পক্ষ থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, যশবন্ত সিনহার নাম প্রস্তাব করেন৷ বাকিরা সমর্থন করেন৷ এরপর বিরোধী দলনেতারা যশবন্ত সিনহাকে নিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিলের জন্য যান৷ এসব হবে তো জানাই ছিল৷ নতুন যা তা হল, তেলঙ্গনা রাষ্ট্রীয় সমিতির সমর্থন৷ তাদের প্রতিনিধি হাজির থাকলেন। থাকল না ঝাড়খন্ড পার্টি৷ এক আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি হবে, তার বিরোধিতা করার রাজনৈতিক ভুল হেমন্ত সোরেন করবেনই বা কেন? বরং এই তালে সরনা ধর্ম কোড বিল, যা পড়েছিল কেন্দ্র সরকারের কাছে, সেটা নিয়ে খানিক দরাদরি হল৷ ইউনিফর্ম সিভিল কোডের প্রবক্তারা, প্রয়োজনে সবকিছুই করতে পারে৷ আর আরএসএস – বিজেপির যাবতীয় আপত্তি তো, মুসলিম পার্সোনাল কোড নিয়ে। কাজেই আদিবাসী রাষ্ট্রপতিকে সমর্থন করাও হল আবার সরনা কোড বিল সম্ভবত পাস হয়ে যাবে, এই শর্তে ঝাড়খন্ড পার্টি, গুরুজি শিবু সোরেনের দল বিরোধী বৈঠকে আগে হাজির থাকলেও, সোমবার হাজির ছিলেন না।
ছিল না বিজেডি৷ ওরা তো সিপিএমের মতো কালিদাস নয়৷ রাজ্য থেকে রাষ্ট্রপতি হবে৷ ওনারা খামোখা বিরোধিতা করবে কেন? এখনও তাস ফেলেননি ওয়াইএসআর পুত্র জগন রেড্ডি৷ তবে একরাশ ইডি আর সিবিআই এর ঝামেলা মাথায় আছে এবং জমিনি লড়াই তো বিজেপির সঙ্গে নয়৷ কাজেই তিনি শেষমেষ দ্রৌপদী মূর্মুকেই বেছে নেবেন৷ সময়ের অপেক্ষা। এই হিসেব ধরলে এই নির্বাচন আনুষ্ঠানিক৷ ফলাফল সবার জানা। কাল যাঁরা গিয়েছিলেন যশবন্ত সিনহার সঙ্গে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে, যশবন্ত সিনহা নিজে, সে সব কথা জানেন। তারপরেও এইসব ঐক্য আয়োজনে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দেন অনেকেই৷ মানে বাক্য সামনে আসে।
আবার সেই বাক্যের মধ্যে কিছু আবার মাণিক্য, ঝলমল করে, তারা থেকে যায়, বহু পরে তারা টুপটাপ ঝরে পড়ে, সেই সব ঐক্য বাক্য মাণিক্য নিয়েই আজকের আলোচনা। প্রথমে ঐক্য নিয়েই কিছু কথা হোক, বিরোধী ঐক্য, বিরোধী ঐক্য, শুনে শুনে কান পচে গেছে। কিরকম ঐক্য? কেরালাতে কং – সিপিএম লড়াই, কী রকম লড়াই? নির্বাচনের সময় রাহুল গান্ধী বলেছিলেন সিপিএমের আদর্শ, মার্কসবাদ, লেনিনবাদ আজ অচল, বস্তাপচা মতাদর্শ নিয়ে টিঁকে থাকা যায় না৷ এদিকে সিপিএম এখনও কংগ্রেসকে, দেশের পুঁজিপতি ও সামন্ত অবশেষের প্রতিনিধিই মনে করে৷ তাদেরকে সরিয়েই নতুন সমাজ গড়ার লক্ষে তাঁরা অবিচল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে জগাই, সিপিএমকে মাধাই, কংগ্রেসকে জগাই মনে করেন৷ বলেছেন বহুবার, ভাষণে বলেছেন, সাক্ষাৎকারে বলেছেন৷ ওদিকে সিপিএমের কমরেড সেলিম সকালে সন্ধ্যায়, প্রতি ঘন্টায় দিদি – মোদি জোটের কথা বলেন৷ গোটা সিপিএম বা বামফ্রন্টের দলগুলোর বক্তব্য একই, দিল্লিতে ইডি এলে মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরি দিল্লির পথে নামেন৷ এই রাজ্যে ইডি আয়, ইডি আয়, সিবিআই আয় আয় বলে বায়না করেন৷ সঙ্গে সিপিএম সাংসদ উকিল বিকাশ ভট্টাচার্য, মানুষ তো এসব দেখছে। ঘোষিত নাস্তিক এনসিপির শারদ পাওয়ার, নিজেকে জনেয়ু ধারি ব্রাহ্মণ বলা রাহুল গান্ধী, বাবরি মসজিদ ভাঙার গর্ব নিয়ে চলা শিবসেনা মহারাষ্ট্রে মহা বিকাশ আগাড়ির সরকার চালাচ্ছে৷ এখন সংকট চলছে, এই মহা বিকাশ আগাড়ির সরকার যদি এক ভোটে পিছিয়ে পড়ে, তাহলে রক্ষাকর্তা কে?
মহারাষ্ট্রের একমাত্র সিপিএম বিধায়ক জিভা পানডু গাভিট। বিরোধী ঐক্যে আছে, ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পিডিপি৷ পিডিপি কিছুদিন আগে বিজেপির সঙ্গে সরকারে ছিল৷ ফারুক আবদুল্লা প্রসঙ্গে পিডিপি নেত্রী মেহেবুবা মুফতি যা যা বলেন, তা কাগজে লেখা যায় না। কংগ্রেস – এসপি উত্তরপ্রদেশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তেলঙ্গনায় বিজেপি উঠে আসছে বটে, কিন্তু লড়াই এখনও টিআরএসআর কংগ্রেসের ভেতরে। কর্ণাটকে দেবেগৌড়ার পার্টি, যযেততে, যখন যেমন, তখন তেমন। আদর্শ গিয়েছে ঘাস কাটতে৷ বিজেপির সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হতে কোনও আপত্তি নেই৷ ওনারাও আছেন বিরোধী ঐক্যে। একমাত্র তামিলনাডুতে ছবিটা মোটের ওপর ভালো৷ তবে এই ডিএমকে এনডিএ-তে ছিল, সে কথাও মনে করা দরকার।
সম্মিলিত বিরোধী প্রার্থী? যশবন্ত সিনহা, তিনি বিজেপির বড় নেতা ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, তার আগে সমাজবাদী ছিলেন, নরেন্দ্র মোদি আসার পর থেকে বিজেপিতে তিনি সাইডলাইনে, তারপর তৃণমূলে। এদিকে মোটের ওপর সোমবারের বাক্য, যা বলা হয়েছে, তার সবটাই হল আদর্শের কথা। এক মহান আদর্শের ভিত্তিতেই নাকি বিরোধী ঐক্য গড়ে উঠেছে, এটা আদর্শের লড়াই, প্রত্যেক দলের নেতারা বলেছেন। মানুষ বিশ্বাস করে? করবে? কেন করবে? কমরেড সেলিম আগামী কাল মোড়ের মাথায় সিঙে ফুঁকে বলবেন, দিদি – মোদি এক হ্যায়, লোকে বিশ্বাস করবে আদর্শের কথা? হ্যাঁ এইখানেই ঝরে ঝরে পড়েছে মাণিক্য। মঙ্গলবারের গণশক্তির হেডলাইন, ব্যক্তি, পরিচিতি সত্তার লড়াই নয়, মতাদর্শের লড়াই, বললেন ইয়েচুরি। হেডলাইনের পরে প্রতিবেদনে আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা, সিপিএম দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের রাষ্ট্রপতি হলেন সংবিধানের অভিভাবক, বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি এরকম যায়গায় চলে গেছে যে, সংবিধানকে রক্ষা করা এবং আমাদের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার রক্ষা করা, এইসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই, রাষ্ট্রপতি পদে যে নির্বাচন হতে চলেছে, তা দুই ব্যক্তির লড়াই নয়, দুই নীতির বিরুদ্ধে লড়াই।
ওদিকে এই সম্মিলিত প্রার্থী ঘোষণার শুরুতেই বলা হয়েছে, আমরা সেকুলার, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে, যশবন্ত সিনহাকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য, নির্বাচিত করেছি। তাহলে কী দাঁড়াল? মানে এক আম বঙ্গবাসী হিসেবে আমি কী বুঝলাম? টিএমসি, সিপিএম, কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ দল৷ এরা প্রত্যেকেই সংবিধানকে রক্ষা করতে চায়, যে সংবিধান কে ধ্বংশ করতে চায় বিজেপি, এই দলগুলো, মানে অ্যাট লিস্ট সিপিএম, টি এম সি, কংগ্রেস সংবিধানে দেওয়া মানুষের অধিকারকে রক্ষা করতে চায়, কিন্তু দিদি মোদি এক হ্যায়, বিজেপি টি এম সি আঁতাত আছে। আচ্ছা, এই দুটোই কিভাবে একসঙ্গে চলবে? তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আছে, বিরোধিতা হোক, সরকারের কাজ নিয়ে, নিয়োগ নীতি নিয়ে, উন্নয়ন নিয়ে, অপরাধ বা দূর্নীতি নিয়ে, চলুক না বিরোধিতা, তীব্র বিরোধিতা হোক, কিন্তু তারপরেও তো বলাই যায়, যে আমরা দুটো দল ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি, সংবিধানে আস্থা রাখি, তাই বৃহত্তর স্বার্থে বিজেপির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি, মানুষ সেটা বিশ্বাস করবে, বা বলা যায় সেটা বিশ্বাস করা সহজ, কিন্তু দিদি – মোদি এক হ্যায়, বিজেমূল বলার পরে আদর্শের ভিত্তিতে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই? হয় নাকি? এক সফল বিরোধী ঐক্যের কথা মনে করা যাক, জরুরি অবস্থার সময়ে জয়প্রকাশ নারায়ণের হাত ধরে, সমস্ত বিরোধী দল, সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, জনসংঘি, নেতা আর দল এক সঙ্গে এলেন, এলেন শুধু নয়, রাস্তায় লড়লেন, জেলে গেলেন, প্রচার করলেন, সভা করলেন, মানুষ বুঝেছিল স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে কিছু মানুষ এক স্বরে গণতন্ত্রের কথা বলছে, সংবিধান রক্ষার কথা বলছে, মানুষ বিশ্বাস করেছিল। অমন শক্তশালী ইন্দিরা গান্ধী, কংগ্রেস ধুয়ে মুছে গিয়েছিল। রাস্তায় ঐক্য চাই, মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঐক্য চাই, ওসব আদর্শ, নীতির কথা বলার পর প্লেনে চেপে রাজ্যে এসে উল্টোগান, মানুষ বুঝে যাবে, বুঝে গিয়েছে।
যদি সত্যিই মনে হয় আরএসএস – বিজেপি, মোদি – শাহ দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে, যদি সত্যিই মনে হয় আরএসএস – বিজেপি এক নোংরা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে সামনে আনছে, যেখানে তাদের লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র, তাদের হাতে দেশের সংখালঘুদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন, দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি বিপন্ন, তারা সংবিধানকেও ধ্বংশ করতে চায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রত্যেকটা দলকে, আন্দোলনের রাস্তাতেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সে লড়াই এ মানুষকে পাশে পেতে গেলে, সে একতাকে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে৷ সমস্যা হল, রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে মানুষের ভরসাই উঠে যাচ্ছে, দেখুন না, রাজনৈতিক দল ছাড়াই আমাদের অন্নদাতারা সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করলো, ছাত্র যুবদের রাস্তায় নামা দেখে আতংকিত সরকার, সি এ এ – এন আর সি র নাম নিচ্ছে না, কিন্তু রাজনৈতিক দল হারিয়েছে সেই বিশ্বাসযোগ্যতা। দিল্লিতে সমবেত হয়ে বিরোধী ঐক্যের কথা বলে, ওয়াইনাড এ রাহুল গান্ধীর দপ্তর ভাঙচুর হবে কেন? ভাঙ্গচুর হল, প্রতিক্রীয়ায় যুব কংগ্রেস, বিমানের মধ্যে পিনারাই ভিজয়ন কে ঘিরে ধরলেন, আগে এমনটা হয়নি। তৃণমূলের সহ সভাপতি বিরোধী প্রার্থী, পলিটব্যুরো নেতা কমরেড সেলিম, এ বাংলায় দিদি – মোদির জোটের কথা বলেই চলেছেন, একে ঐক্য বলে না, বললেও মানুষ একে ঐক্য বলে মেনে নেবে না। আর রাস্তায় ঐক্য গড়ে না উঠলে, কেবল রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর ওপর সিলমোহর দিলে, দিতে থাকলে, বিজেপি আরও বহু বছর ৩৭/৪০% ভোট নিয়েই দেশের সংবিধানের খোল নলচে বদলে দেবে, এটা না বোঝার মত বালখিল্যদের রাজনীতি না করাই ভালো।