হোয়ার অর্ডার ইজ ইনজাস্টিস, ডিসঅর্ডার ইজ দ্য বিগিনিং অফ জাস্টিস। যখন নিয়মটাই হয়ে দাঁড়ায় শোষণ, লুন্ঠন আর অত্যাচার৷ তখন বেনিয়মেই সেই অত্যাচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, লড়তে হয়। আমাদের দেশের মানুষকে এই কথা শিখিয়েছিলেন কারা? আদিবাসীরা, সাঁওতালরা, কোল, ভিল, মুন্ডা, ওঁরাওরা। সে লড়াই গদি বাঁচানোর লড়াই ছিল না, সে লড়াই রাজত্ব বাঁচানোর লড়াই ছিল না৷ তা ছিল বাঁচবার লড়াই। আমাদের ইতিহাস বইতে লেখা হয়, ১৮৫৭তে সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার দু’বছর আগে এই সাঁওতাল পরগনা, এই জঙ্গলমহল দেখেছিল আর এক স্বাধীনতা আন্দোলনের ছবি৷ ১৮৫৭ র বিদ্রোহীদের নেতারা ছিল রাজা, নবাব, রানী আর সিপাহী, তাদের লড়াই ছিল কেবল ইংরেজদের বিরুদ্ধে, ১৮৫৫ র দিকে তাকিয়ে দেখুন, এ লড়াই ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে, স্থানীয় জমিদার, লুঠেরাদের বিরুদ্ধে, সিধু – কানু, চাঁদ – ভৈরব, ফুলমণি, ঝানোরা ভাল করেই জানতো, কেবল ইংরেজ নয়, স্থানীয় জমিদার, লুঠেরাদের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে, তাই হাতে তুলে ছিল অস্ত্র, ডাক দিয়েছি উলুগুলানের, কলেয়ান গুরুর লেখা “হড়কোড়েন মারে হাপড়ামকো রেয়াঃ কথা” এইজন্যই অবশ্যপাঠ্য, পড়া উচিত প্রত্যেকের, সেই ১৮৫৫ তে জল জঙ্গল, জমিন আসমানের যে লড়াই যে হুল এর ডাক দেওয়া হয়েছিল, তা এখনও প্রাসঙ্গিক। কী হয়েছিল সেদিন? সেদিন আদিবাসীরা বলেছিলেন, সমস্বরে বলেছিলেন, ‘আদ বাংবন পৌচঃ সিধু আদ বাংবন থিরঃ,
বাইরি ঞেলতে লৌড়হাই ঘন বাংবন ঞিরঃ।
বহঃক্ ঞুরুঃ রেহঁ সিধু মায়াম লিঙ্গি রেহঁ,
বাংবন পাচঃ লৌড়হাই আবন দেবন সহরঃ।।
‘আর আমরা পিছু হঠব না, সিধু আর চুপ থাকবে না,
শত্রু দেখে লড়াই থেকে পালাব না,
মাথা উড়ে গেলেও সিধুর রক্ত বইতে থাকলেও,
আমরা আর পিছু হটবনা,লড়াই মুখো হব।।’
৩০ জুন ১৮৫৫, বীরভূমের ভাগিনাডিহি থেকে সিধু কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল, কুমোর, তেলি কর্মকার, চামার, ডোম, মোমিন সম্প্রদায়ের গরিব মুসলমান, গরিব হিন্দু মানুষ এই উপমহাদেশের প্রথম লং মার্চ শুরু করে৷ কলকাতা, যেখান থেকে ব্রিটিশরা শাসন করছিল ভারতবর্ষ, সেই দিকে রওনা দেয়৷ কোনও চোরা গোপ্তা লড়াই নয়, রাজধানী দখল করার জন্য লং মার্চ৷ দিকুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য লং মার্চ। হ্যাঁ এই উপমহাদেশে সেটাই ছিল প্রথম লং মার্চ৷ এরপরে চীনে লাল ফৌজের লং মার্চের কথা আমরা জানি৷ মনে রাখেনি এই ৩০ হাজার মানুষের লং মার্চের কথা, সম্ভবত তার নেতৃত্বে না ছিল কোনও তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ, না ছিল কোনও তথাকথিত আদর্শ, তারা রাস্তায় নেমেছিল, জীবন জীবিকার জন্য, বাঁচার জন্য।
নেতৃত্বে সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব। কেবল পুরুষ নয়, সাঁওতাল মেয়েরাও ছিলেন এই লড়াই এর সামনের সারিতে, ফুলো মুরমু, ঝানো মুরমু। বীর ইংরেজরা ফুলো মুরমুকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। সেই কবে ১৭৮৫তে তিলকা মাঁঝি যে লড়াই শুরু করেছিল, তারপর আরও ৫ টা হুল হয়েছে৷ ১৮৫৫ র সাঁওতাল হুল ছিল তারই শিক্ষা নিয়ে আরও বড় লড়াই। এই ১৮৫৫ র হুল বা এই উলুগুলানের ডাকের, কিছু বৈশিষ্ঠ আছে, প্রথম কথা হল, সাঁওতাল বা আদিবাসীদের বিদ্রোহ কিন্তু ১৮৫৫ নয়, তার বহু আগে, যখন ভারতবর্ষে তেমন কোনও বিদ্রোহের খবরই নেই, সেই তখন ১৭৮৫ তে শুরু হয়েছিল, তিলকা মাঁঝির লড়াই, প্রথম হুল, প্রথম উলুগুলানের ডাক। মাথায় রাখুন, ১৭৫৭ তে সবে লর্ড ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধ জিতেছে। এবং তারপর প্রথম প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এসেছিল আদিবাসীদের কাছ থেকে, তারা শত্রু চিনতে ভুল করেনি।
দ্বিতীয় কথা হল ১৮৫৫ র হুল ছিল গরিব মানুষের, গরিব কৃষকের, নেতৃত্বে অবশ্যই ছিলেন সিধু কানু, কিন্তু সঙ্গে ছিল বহু অন্য বর্ণের, অন্য ধর্মের গরিব মানুষজন। লড়াইটা ছিল জমিদারদের লুঠ, ইংরেজ পুলিসের সাহায্যে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আদিবাসী সাঁওতাল অরণ্য অঞ্চলের পতিত জমি উদ্ধার করে, চাষবাস করে, সেই জমিকে উর্বর করে তুলেছিল, ব্রিটিশ সরকার এসেই সেই জমির উপরে চড়া হারে রাজস্ব চাপায়৷ আর ব্রিটিশদের পোষা জমিদাররা এই খাজনা আদায়ে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল৷ এই চড়া করের চাপে সাঁওতালরা তাদের জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিল।
ভূমি রাজস্ব ছাড়াও সরকার, জমিদাররা সাঁওতালদের ওপর আরও অন্য ধরনের করের বোঝা, কখনও উৎসবের নামে, কখনও মন্দির তৈরি করার নামে, চাপিয়ে দেয় ফলে দরিদ্র সাঁওতালদের দুর্দশা বাড়তে থাকে।
জমিদারেরা নগদে ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর দিতে বাধ্য করতো, ফলে সাঁওতাল বা গরিব মানুষেরা, মহাজনদের কাছ থেকে বিরাট চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হতো। পরবর্তীতে ঋণের দায়ে তারা তাদের জমি, ফসল, বলদ, সমস্তকিছুই মহাজনদের কাছে হারাতো, মহাজনরা কেড়ে নিত।
বহিরাগত ব্যবসায়ীরা অর্থাৎ দিকুরা কেনারাম ও বেচারাম বাটখারা,মানে কেনার সময় একরকম বাটখারা বিক্রির সময় আরেক রকমের বাটখারা ব্যবহার করে, সাঁওতালদের ঠকাত। যখন এই বিষয়টা সাঁওতালরা জানতে পারে, তখন তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে, রেলপথ নির্মাণের কাজে সাঁওতাল শ্রমিকদের নিয়োগ করে তাদের খুব কম মজুরি দেওয়া হত, খালি তাই নয়, রেলের ঠিকাদার ও ইংরেজ কর্মচারীরা সাঁওতাল মেয়েদের ওপর নানা ভাবে অত্যাচার করত৷ এটা ছিল তাদের অধিকারের মত৷ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে, কন্ট্রাকটার বাবুর ঘরে যা, সাঁওতাল যুবকরা দিনের পর দিন এসব সহ্য করেছে । রাজমহল পাহাড় এর প্রান্তদেশে, অর্থাৎ দামিন-ই-কোহ তে যেখানে সাঁওতালরা থাকত, সেখানে সাঁওতালদের নিজস্ব আইন ও বিচার পদ্ধতি ছিল, তা বাতিল করে ব্রিটিশ সরকার এই এলাকায় ইংরেজদের জটিল আইন, বিচার ব্যবস্থা চালু করে , যা সাঁওতালদের মোটেই পছন্দ হয়নি। মানে খুব পরিষ্কার, এটা ছিল আদিবাসী মানুষদের বাঁচার লড়াই, এই শোষণের বিরুদ্ধেই তারা সংঘবদ্ধ হয়, কেবল সাঁওতাল রা? না তাও নয়, হিন্দু গরিব মানুষজন, এমন কি মুসলমানও। ধর্ম বিবেচনার মধ্যেই ছিল না, তারা সেদিন বলেছিল, ইশ্বর মহান, কিন্তু তিনি থাকেন বহু দূরে, আমাদের বাঁচানোর কেউ নেই, তাই অস্ত্র ধর। হ্যাঁ উলুগুলানের প্রথম সংঘর্ষে দারোগা, জমিদার সমেত ১৯ জনকে মেরেছিল বিদ্রোহীরা।
কেবলমাত্র তীর ধনুক আর সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেই বিদ্রোহের নায়করা শুরুর দিকে বেশ কিছু লড়াই এ জিতেওছিলেন, যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের, ইংরেজ সাহেবদের তো বটেই।
এই বিদ্রোহ দমন করেছিল ইংরেজরা, আর দমন করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৩৭শ, ৭ম, ৩১শ রেজিমেন্ট, হিল রেঞ্জার্স, ৪৩, ৪২ ও ১৩ রেজিমেন্ট প্রকে মাঠে নামিয়েছিল, তাতেও কুলোয়নি৷ সাঁওতাল নেতাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য, প্রধান নায়কের জন্য দশ হাজার টাকা, সহকারি নায়কের প্রত্যেকের জন্য পাঁচ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় নায়কদের জন্য, এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। মাথায় রাখবেন সালটা ১৮৫৫৷ তখনকার ১০ হাজার মানে এখন ৬০/৭০ লক্ষ টাকা। বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্য নিয়ে। যে ইংরেজ সাহেবরা নেতৃত্ব দিতে এসেছিলেন, তাদের কয়েকজন লিখেছেন, পরিস্কার লিখেছেন, যে তাঁরা অন্যায় যুদ্ধ করেছিলেন, গণহত্যা করেছিলেন।
১৮৫৫ র হুল দমন করা গিয়েছিল৷ কিন্তু এই হুল, এই বিদ্রোহই ১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিল৷ দেশ স্বাধীন হল বটে কিন্তু আদিবাসীরা কল্কে পেল না কোথাও। বার বার তাদেরকে জমি ছেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে, চলে যেতে হয়েছে, উন্নয়নের নামে তাদের জঙ্গল কাড়া হয়েছে, তাদের পাহাড় কাটা হয়েছে, তাদের জল, জমি, জঙ্গলের বিনিময়ে দেশের তথাকথিত উন্নয়নের কাজ চলছে। না সাঁওতাল, আদিবাসীরা একটা গাছও ইচ্ছে করে কাটেনি, প্রকৃতির এ হিসেব নিকেশ তারা বহু আগেই বুঝেছিল, আজ যখন গ্লোবাল সামিটে পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়, তখন তারা হাসে, তাদের বাপ ঠাকুরদা, ঠাকুমা, মা, দিদারা যে কথা বলে এসেছে এতদিন, শহরের শিক্ষিত মানুষেরা সেই কথাগুলো আজ বলছে। কিন্তু তারপরেও থেমে নেই ধ্বংসযজ্ঞ। একজন আদিবাসী মহিলাকে রাষ্ট্রপতি বানালেই আদিবাসীরা জল জঙ্গল জমিনের অধিকার পাবে না, এই ভূমির আদি বাসিন্দারা আজ তাদের হকের লড়াই লড়ছে, যারা এই আসমান, এই নদী, জঙ্গল পাহাড় এর আসল মালিক।
স্বাধীনতার পর থেকে যাদের জমি, জাদের জঙ্গল কেড়ে নিয়ে আজকের এই শহরের সভ্যতা, হিসেব বলছে স্বাধীনতার পর থেকে বিস্থাপিত মানুষ, মানে যাদের ঘর ভেঙে, ঝুপড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে রাস্তা, কল কারখানা, ফ্লাইওভার, তাদের ৭৬ জন হলেন আদিবাসী। মানে আদিবাসীদের ঘর ভেঙেই তৈরি হচ্ছে এই নগর, শহর, বন্দর, সভ্যতা। অথচ আদিবাসী বললেই আমাদের মাথায় যে ছবি আসে তা হল খেটো ধুতি আর গেঞ্জি, মাথায় আসে শালপাতায় ভাত আর একটু সবজি, মাথায় আসে ঝুপড়ি, যেখানে বর্ষায় জল টপকায়, শীতে মানুষ কুঁকড়ে শুয়ে থাকে। কেন এমনটা হল? কারা করল? কাদের পরিকল্পনায় হল? কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনে এসব হয়েছে, সত্যি। কিন্তু এই বিজেপি সরকার আসার পর থেকে তা এক চুড়ান্ত রুপ নিচ্ছে, এই সরকারের মাথা দেশের সবকিছুই আদানি, আম্বানির মত কিছু ব্যবসায়ীর হাতে গোটা দেশ বেচে দিতে চায়। বিজেপি তো কেবল একটা রাজনৈতিক দল নয়, তাদের মাথায় আছে আরএসএস। আরএসএস বিজেপি সংঘ পরিবার চায় এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম।
আদিবাসীদের দেশ কোনটা? যেখানে পাহাড় আছে, নদী আছে, জঙ্গল আছে সেটাই আদিবাসীদের দেশ। যে পাহাড় এই সরকার বিক্রি করে দিতে চায়, যে জঙ্গল থেকে মানুষ কে উৎখাত করতে চায় এই কেন্দ্রীয় সরকার, জঙ্গল কেটে পাহাড় কেটে মাটির থকে খনি বার করা হবে, তার লাভ কারা পাচ্ছে? আদিবাসীরা? তাদের পবিত্র পাহাড় খুঁড়ে ডলোমাইট বক্সাইট বার করে আনছে, কর্পোরেট কোম্পানি, আদানি, নিজের জমি থেকে উৎখাত হচ্ছে কারা? নিয়মগিরি তে আদিবাসীরা জানিয়ে দিয়েছে তাদের পবিত্র পাহাড় কাটা যাবে না, কারা গুলি চালালো? কারা মরলো? সেই আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য কথা বলতে এসেছে বিজেপি। আজ এই হুল দিবসে আবার সেই উলুগুলানের ডাক দিতে হবে, বলতে হবে গ্রাম ছাড়বো না, জমি দেবো না, এই জল জঙ্গল জমিনের জন্য জান কবুল, আমরা লড়ে যাবো।