জাতীয় চ্যানেলের সাংবাদিককে আগেই জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে,ক্রিকেট নিয়ে আগে বলতে হবে,নাকি টুইট নিয়ে? এই মুহুর্তে স্বাভাবিক উত্তর: আভি জো চল রহা হ্যায়। মনে সেই টুইটার কিসসা। কালো হাল্কা মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকা। চোখে কোনও উত্তেজনার ঝিলিক নেই। একই রকম মেজাজে আছেন-পাপালি। ওরফে ঋদ্ধিমান সাহা। গত ৪৮ ঘণ্টায় টুইটারে ট্রেন্ডিং তালিকায় রয়ে গেছেন তিনি। #Wriddhimansaha লিখলেই, রোজ ৩০০-৪০০ করে পোস্ট হচ্ছে এই হ্যাশট্যাগ দিয়ে। নিয়মিত পড়ছেন? টুইট নিজে করেন? কেমন মনের অবস্থায় আইপিএল খেলতে নামবেন? কবে নাম জানাবেন সেই হুমকি দেওয়া সাংবাদিকের নাম? কেন সৌরভের ব্যক্তিগত টুইট সকলের সামনে বলে দিলেন?-এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর ঠান্ডা মানসিকতায়, হাসি মুখে কলকাতা টিভি ডিজিটালে (kolkatatv.org) দিলেন ঋদ্ধিমান। প্রায় দেড় ঘন্টার ময়দানি আড্ডার কিছু অংশ রইলো এই প্রতিবেদনে।
প্রশ্ন:মেজাজের সঙ্গে মিলিয়ে কি বলা যায়: “সাহা কা গুসা কিউ আতা হ্যায়?”
ঋদ্ধি: এমন একটা কিছু সিনেমার নাম শুনেছিলাম। আমার সঙ্গে জড়ালে কেন? দ্যাখো , আমাকে তো চেনো — ওসব আমার আসে না। যা করেছি, ভেবে চিন্তে করেছি।
প্রশ্ন:তাহলে বলছো, জার্নালিস্টের হুমকি হোয়াটসঅ্যাপ টুইট করাটা ভেবে চিনতে করা!
ঋদ্ধি: নিশ্চই। আমি আমার স্ত্রী, বাবা – মা , কোচ , ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আর আমার নিজের ডিজিটাল টিমের সঙ্গে আলোচনার পর এটা করি।
After all of my contributions to Indian cricket..this is what I face from a so called “Respected” journalist! This is where the journalism has gone. pic.twitter.com/woVyq1sOZX
— Wriddhiman Saha (@Wriddhipops) February 19, 2022
প্রশ্ন:এটি কি হুমকি?
ঋদ্ধি: তোমার পড়ে কি মনে হল? ১০ -১১ জন সাংবাদিকের সঙ্গে আমি কথা বলবো, সে তো আমার পছন্দ। আমি কোনো স্বার্থ নিয়ে কারোর সঙ্গে কথা বলিনা। মনেও করি না, কে বড় আর কে ছোট ( সাংবাদিক হিসেবে)। তাই এই মেসেজটা পাওয়ার পর মনে হয়েছিল – ভবিষ্যতে এমন সাহস যাতে আর কেউ দেখাতে না পারে, কিছু একটা করা দরকার। আগেও শুনেছি এমন কিছু হয়েছে। কেউ বলেনি। সামনে আনেনি। আমি ক্রিকেটারদের হয়েই এটা করেছি।
প্রশ্ন:কিন্তু গোটা দেশ জানতে চাইছে-কে এই সাংবাদিক? বোর্ড কি তোমার কাছে জানতে চেয়েছে?
ঋদ্ধি: জানি , সকলে নাম জানতে চাইছে। বোর্ডের থেকে ফোন পেয়েছি। মেইল পেয়েছি। কথাও বলেছি। মেইলের উত্তরও পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখনও আমি নাম বলিনি। আপাতত বলবো না।
প্রশ্ন:কেন! না জানলে অন্য ক্রিকেটাররা সচেতন কিভাবে হবে?
ঋদ্ধি: আমি কারোর রুটি – রুজি নিয়ে ছেলেখেলা করি না। করতে চাই না। সেই সাংবাদিকের যদি অনুশোচনা হয়, তারজন্য এটা সুযোগ দেওয়া রইলো। তাও না হলে — জানি না পরে কি হবে। তাই আপাতত নামটা কাউকেও জানাচ্ছি না।
প্রশ্ন: তাই কি বোর্ডের মেইলের উত্তর দিয়ে তিনটে আরও টুইট করলে, ওয়ান / টু / থ্রি করে ?
ঋদ্ধি: মনে করে দেখতে হবে পরের মেইল গুলো কখন করেছি ( মাস্কের তলায় হাসির ঝলক)। বোর্ডকে না জানিয়ে আমি কিছু করিনা। তাই মনে হচ্ছে বোর্ডের মেইলের উত্তর দিয়েই ওই তিনটে লিখেছি।
1/3- I was hurt and offended. I thought not to tolerate such kind of behaviour and didn’t want anyone to go through these kind of bullying. I decided I will go out and expose the chat in public eye, but not his/her name
— Wriddhiman Saha (@Wriddhipops) February 22, 2022
প্রশ্ন:আচ্ছা, কোচ রাহুল দ্রাবিড় নিজে ডেকে ঋদ্ধিকে বললেন, ” আরে ‘তোকে’ বলতেও খারাপ লাগছে – ভবিষ্যতের জন্য আরও কাউকে তৈরি করতে হবে। তাই ‘অন্য কিছু’ ভাবতে পারিস তুই । শ্রীলঙ্কা সিরিজে নির্বাচকরা নাও ভাবতে পারে তোর নাম। ” কিসের ইঙ্গিত ছিল? অবসর?
ঋদ্ধি:(হাসতে হাসতে) পরে তাই তো মনে হল। আরে তাও তো রাহুল ভাই, সোজা কথাটা সোজা ভাবে আমাকেই ডেকে বলেছে। যখন ডেকেছিল রুমে – খেলাতে পারছে না, তাই বোধ হয় দুঃখ প্রকাশ করবে। কিন্তু যা শুনলাম, তাতে অবাক হয়েছিলাম। এই তো সবে, শেষ টেস্টে যেটা খেলেছি – তাতে কাঁধে চোট নিয়ে ব্যাট করেছি। ৬১ রান করেছিলাম টান্স বদলে। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে একটাও ম্যাচ খেললাম না। কি দেখে আমাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে? জানতে চেয়েছিলাম, ফিটনেস? ফর্ম? নাকি বয়স? এর কোনোটাই – উত্তরে মেলেনি। নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান চেতন শর্মার ফোনে পেলাম। রাহুল ভাইয়ের মতো কথা। বাদ কেন! এই উত্তরটা মেনে নিতে পারছিনা। পারফরম্যান্স আর ফিটনেস দেখিয়েও বাদ!
আরও অবাক হয়েছি, দল নির্বাচনের আগে বোর্ডের কোনও বড় কর্তা নাকি কোনও নিউজ এজেন্সিকে বলে দিয়েছিল, শ্রীলঙ্কা সিরিজের দল কি হবে। কে কে বাদ যাবে। এগুলো কিভাবে আগে বাইরে চলে আসে! দ্যাখো, আমি ভালোবেসে, ভালো লাগা থেকে খেলতে এসেছি। যেদিন আর খেলতে ভালো লাগবে না, সেদিন কাউকে বলতে হবে না – কারোর জায়গা আটকে রাখবো না।
প্রশ্ন:এটা অভিমান? নাকি দুঃখ?
ঋদ্ধি: কিছুই নয়। মনের কথা।
প্রশ্ন:জাতীয় নির্বাচক চেতন শর্মার নামও বলে দিলে! তিনি ফোন করে কি বললেন – তাও বলে দিলে!
ঋদ্ধি: আমি যেচে কাউকে কিছুই বলি নি। বলতে যাইনা। সেটা আমার স্বভাবই নয়। আমাকে যা যা প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাই বলেছি।
প্রশ্ন:বোর্ড সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের এস এম এসটা? সেটাও তো বলে দিলে।
ঋদ্ধি: প্রশ্নটা কেউ শুনলে এটা হয়তো বলা হতো না। ‘ দাদি ‘ ভারতীয় ক্রিকেটের আইকন। তিনি মোটিভেট করার মতো এস এম এস করলে , তা বলারই মত।
প্রশ্ন:কিন্তু সৌরভের দাদা সি এ বি – র সচিব স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় তো তোমার সমালোচনা করেছে। বলেছে, সৌরভের পাঠানো ব্যাক্তিগত এসএমএস প্রচার মাধ্যমে জানানো ঠিক হয়নি।
ঋদ্ধি: উনি কি বলছেন, সেটা ওনার ব্যাপার। আমার নয়। যে প্রশ্ন আমায় করা হয়েছিল, ওটা তার উত্তরে বলা।
প্রশ্ন:সিএবি সচিব বলেছেন, তোমাকে বাদ দেওয়া নিয়ে সংস্থা বিসিসিআই এর সঙ্গে কোনও লড়াইয়ে যাবে না। কিছু বলাই হবে না।
ঋদ্ধি: আমি তো কাউকেই কিছু বলার কথা বলিনি। নিজের যোগ্যতা আর পরিশ্রমের ভরসায় সেই শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় খেলেছি। তারপর দেশে খেলেছি। তারপর দেশের হয়ে ১২ বছর দেশের বাইরেও খেলেছি। আমার হয়ে কাউকে কিছু বলতে বলি নি। বলবো না। আমার স্বভাবই নয়।
প্রশ্ন:শিলিগুড়ি বললে বলে মনে পড়ল, তোমার কাছের মানুষ শিলিগুড়ির প্রাক্তন মেয়র সৌরভের ঘনিষ্ঠ মানুষটি বোর্ড প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখেছেন – তোমাকে এভাবে বাদ দেওয়ার সিধ্যান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য। তুমি জানো?
ঋদ্ধি: অশোক জ্যেঠু ফোনে করে সবসময় খোঁজ নেন। বলেছেন এটাও । আমি কিন্তু কাউকে কিছু করার জন্য বলিনি।
প্রশ্ন:সিএবি থেকে বলা হয়েছে, তুমি যখনই চাইবে বাংলার হয়ে খেলতে নামতে পারে।
ঋদ্ধি: আসলে আমি জানতাম না, রাহুল ভাইয়ের বলা কথা বা প্রচার মাধ্যমে রটনা সত্যি হয়ে যাবে। শ্রীলঙ্কা সিরিজের দুটি টেস্টে আমার জায়গা হবে না। আমার তো বায়ো বাবলের জীবন হয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলাম। আমার স্ত্রী ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়েছিল। এই রোগে সারতে সময় লাগে। আমাদের দুটি সন্তান। ছেলে সবে কয়েক বছরের। দু ‘ জনকে ওর পক্ষে একা সামলানো কঠিন। তাই চেয়েছিলাম : পরিবারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো দরকার। বাংলার হয়ে রঞ্জিতে এবার খেলবো না – সেটা সভাপতিকে বলে এসেছিলাম। ফোন করে নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম। আর একটা কথা, খেলতে যতদিন ভালো লাগবে, সেরাটা দিতে পারবো – খেলে যাবে। তা ক্লাব ম্যাচ হোক, কিংবা বাংলার হয়ে হোক , বা আই পি এল হোক। আর জাতীয় দলের হয়ে খেলা তো বিশাল সম্মান।
প্রশ্ন:আজ নিজের মনে হয় না, তোমার জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলার মেয়াদটা ১০-১১ বছরের হলেও, চুটিয়ে খেলতে পেরেছো মাত্র ৩-৪ বছর। আজ অন্যদের জন্য যেভাবে তোমাকে কোচ ডেকে বলছে, তোমার জন্য অন্যদের আগে কেউ তো এটা বলেনি। খারাপ লাগে না?
ঋদ্ধি: নাহ। লাগে না। কারণ, ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে আমি সেই ১৬ জন যারা দেশের হয়ে নির্বাচিত হয়েছে বছরের পর বছর। প্রথম একাদশে থাকলে দারুণ লাগে। কিন্তু দলে আছি সেটাও আমার কাছে, সমান গর্বের।
আর যেটা বললে, সেটা ঠিক । আমি বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই নি। মাহি ভাই যখন ছিল, তখন ও অধিনায়ক আর উইকেটকিপার। দুটোতেই দক্ষ। তাই আমি স্ট্যান্ড বাই ছিলাম। মাহি ভাই টেস্ট ম্যাচ খেলা ছাড়তেই যে সুযোগটা পেলাম তা পেয়ে সেরাটা দেওয়ায় চেষ্টা করে গেছি সবসময়।
প্রশ্ন:আর এসবের সঙ্গে চোট তো তোমার যমজ ভাই….
ঋদ্ধি: আরে চোট – আঘাত যে কোনও খেলার অঙ্গ। এটা এড়ানো মুস্কিল। আমিও পারিনি। শেষবার অপারেশনটা হতে গিয়ে বেশি সময় লাগলো মাঠে ফিরতে। ততক্ষনে পন্থ এসে গেছে।
প্রশ্ন:তাহলে তুমি বাতিলের খাতায় গেলে পন্থ চলে আসায়! আর সেই পন্থকে অনুশীলনে নানান পরামর্শ দিতে তুমি! তখনকার কোচ রবি শাস্ত্রী এমনটাই বলেছেন। সত্যি?
ঋদ্ধি: এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের ফিল্ডিং কোচ ছিলেন অনেকদিন ধরে শ্রীধর। উনি বলেছিলেন, তাই পন্থকে বেশ কিছু কিপিং সমস্যা সামলাতে কিছু পরামর্শ দিতাম। প্রথম প্রথম সে সেগুলো সামলাতে পারতো না। এখন পারছে।
প্রশ্ন:এ আবার কী! পেশাদার দুনিয়ায় যেচে নিজের কবর নিজে খুঁড়েছো !
ঋদ্ধি: দেশের হয়ে খেলতে নামছে দল। যে খেলার সুযোগ পাচ্ছে, তাকে সাপোর্ট দরকার হলে দিতে হবে। আমার ইগো তে লাগে না। বাংলারও অনেকে আছে। ফোন করে। আমি চেষ্টা করি, তা সামলানোর রাস্তা বলে দিতে।
প্রশ্ন:সামনে তো তাহলে শুধু আই পি এল। মানসিক বা বিশেষ কোনও প্রস্তুতি শুরু করেছো?
ঋদ্ধি: নাহ। এই ক্যাম্পে এসেছি।আর তোমাদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে ছেলে – মেয়ে আর পরিবার। সময় তো ফ্যামিলিকে দিতে হবে।
প্রশ্ন:এবার তো আইপিএল খেলতে নেমে কিছু মুখ, কিছু কথা মনে পড়বে….
ঋদ্ধি: কেন! কাদের!
প্রশ্ন:তোমার রাহুল ভাই, চেতন শর্মা। আর এই সাংবাদিক…
ঋদ্ধি: আরে না না… আমি এখন এসব নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি ঠিকই। আইপিএলের জন্য গুজরাট শিবিরে ঢুকে গেলে, ক্রিকেট ছাড়া আর কিছুই মনে থাকবে না। আসলে আমি ক্রিকেট খেলা ছাড়া আর কিছুই ভাবি না। ভাবতে চাইও না। আমি যে দলের হয়ে যখন খেলি, সেই দলের জয় ছাড়া আর কিছুই আর ভাবি না।
Looking forward! @gujarat_titans https://t.co/rBWFDTxi64
— Wriddhiman Saha (@Wriddhipops) February 13, 2022
প্রশ্ন:আচ্ছা, এত যে প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছো, তাতে সেই সাংবাদিক ইস্যু নিয়ে বেশি কথা হয়ে যাচ্ছে। তোমার বাদ পড়া ইস্যুটা তো তুমি নিজেই অন্য ইস্যু টেনে এনে ফিকে করে দিলে! পরে তো সাংবাদিককে বুঝিয়ে দিতে পারতে।
ঋদ্ধি: আগেও বলেছি, আমি নিজের সেরা খেলাটা খেলে যেতে ভালোবাসি। কাউকে নিয়ে কোনও কথা বলতে দেখেছো? আমি বাদ গেছি, মেনে নিয়েছি। আঘাত তো তার উপর বারবার হয়, যে বারবার তা সামলে আবার লড়াইয়ে ফিরে আসে। তাই আমি পছন্দ করি। সেই কারণে, নিজের কথা না ভেবে টুইট করে সকলকে সাবধান করতে চেয়েছি। প্রেস কনফারেন্স ডেকে করিনি।
প্রশ্ন: তাহলে এরপর?
ঋদ্ধি: আপাতত ফ্যামিলি আর আইপিএল। সঙ্গে বাংলার ক্রিকেটকে সবরকমভাবে সাহায্য করা।
নিজস্ব চিত্র।