আজ একেবারেই রিক্ত, একেবারেই নিঃস্ব। না তিনি সিপিএম রাজ্য কমিটির সদস্য, না তিনি পলিটব্যুরোর সদস্য, না তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আজ থেকে তিনি শুধুই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য।
কে তিনি?
৮৩ বছরের যুবক বিমান বসু। সেই কবে শৈশবে বাড়ি ছেড়েছিলেন বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি করবেন বলে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে উত্তাল বঙ্গ রাজনীতি, উত্তাল ছাত্র রাজনীতি। তখন থেকে ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারিতে। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিসের লাঠি খেয়েছেন, জেলে গিয়েছেন। তবু দমানো যায়নি বিমান বসুকে। অবিভক্ত বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে সিপিএম, সিপিআই হয়। বিমান দা সিপিএমেই থেকে যান। তারও পরে সত্তরের দশকে
বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন ভেঙে স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া হয়। বিমান দা তারও প্রথম সাধারণ সম্পাদক হন। সেই সময়কার বামপন্থী ছাত্র নেতা শ্যামল চক্রবর্তী, সুভাষ চক্রবর্তী, অনিল বিশ্বাস, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর মতো অনেকেই বিমান বসুর হাত ধরে উঠে এসেছেন। বস্তুত গত শতকের পাঁচের দশক থেকেই ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ থেকে শুরু করে খাদ্য আন্দোলন, সব কিছুতেই ছাত্রদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। ছাত্রদের নেতৃত্বে ছিলেন বিমান বসু। তারও পরে ১৯৬৭, ১৯৬৯ এ কংগ্রেসকে হারিয়ে পিউইএলএফ এবং এলডিএফ সরকার হল। কংগ্রেস বিরোধী দুই সরকারই পুরো পাঁচ বছর চলল না।
এল ১৯৭২ সাল। তার আগে থেকেই শুরু হয়েছে নকশালদের বাড়বাড়ন্ত। খুনোখুনির রাজত্ব শুরু হয়ে গেল। ৭১, ৭২ সালে ভোটের নামে হল প্রহসন। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রিগিংয়ের অভিযোগ উঠল। তখনকার কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে চলল বাম এবং নকশাল নিধন যজ্ঞ। কংগ্রেসও অন্তর্দলীয় কোন্দলে জর্জরিত। ‘৭৫ সালে দেশে জারি হল জরুরি অবস্থা। ‘ ৭৭ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার। কেন্দ্রে হল জনতা দলের নেতৃত্বে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা। রাজ্যে হল বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা।
আরও পড়ুন- Congress Sonia Gandhi: চরম সংকটে সোনিয়ার দল
এই সব দিনগুলিতে বিমান বসুর ঠিকানা ছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের রাজ্য দফতর কিংবা একটু দূরের পার্টি কমিউন। নিজেই রান্না করেন, জামাকাপড় কাচেন। অলিমুদ্দিনের ছাদে ফুল ফলের বাগান করেন। মাঝে মাঝেই সাংবাদিকদের দেখাতে নিয়ে যান সেই ছাদ বাগান। চেন স্মোকার বিমান দাকে কখনও অসুস্থ হতে দেখা যায়নি। কেউ কখনও তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখেননি। আজকাল শাসকদলের নেতা, মন্ত্রীদের কারণে অকারণে এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হতে দেখা যায়। সেদিক দিয়ে বিমান দা ব্যতিক্রম।
বিমান দা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন, ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছেন। পরে গিয়েছেন পলিটব্যুরোতে। এখন তিনি কেবল রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান।
আগেই বলেছি, বিমান দাকে কখনও অসুস্থ হতে দেখিনি। দলের যে কোনও আন্দোলন, পদযাত্রায় এই বয়সেও তিনি সামনের সারিতে। বাম জমানায় বক্রেশ্বর প্রকল্পের দাবিতে কলকাতা থেকে বক্রেশ্বর পর্যন্ত পদযাত্রায় তিনি গোটা পথ হেঁটেছেন। এই তৃণমূল জমানাতেও দলের কোনও না কোনও পদযাত্রায় তাঁকে পুরোভাগে হাঁটতে দেখা গিয়েছে। কিছুদিন আগেই পুলিসের হাতে মারও খেয়েছেন তিনি।
বয়স সংক্রান্ত নীতির কারণে রবিবার কেরালার কান্নুরে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ বাদ পড়েছেন বিমান দা, বাদ পড়েছেন পলিটব্যুরো থেকেও। তবে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। রবিবার তিনি বলেন, যতদিন বাঁচব, দলই আমার সব। এত বছর দলের সব কমিটিতে থাকার পর আজ সরে যেতে হওয়ায় বিমান দার চোখের কোণে একফোঁটা জল দেখা গিয়েছিল কি না, জানা যায়নি। তবে মন যে একটু বিষণ্ন হয়েছে এটা বলাই যেতে পারে। সবাই তো রক্ত মাংসের মানুষ। যদিও বিমান দাকে যতটুকু জানি, তিনি পদে না থাকলেও আজও সমস্ত বাম আন্দোলনের প্রথম সারিতেই থাকবেন।