সংসদের বাদল অধিবেশনে জিনিসপত্রের দরদাম বাড়া নিয়ে এক প্রস্থ বিতর্ক হয়েছিল। যদিও তর্ক-বিতর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন গা নেই, ভাবখানা এমন যেন, তোরা যে যা বলিস ভাই, আমরা কেয়ার করি থোড়াই। এর আগেও বারবার অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন সংসদে আলোচনা ছাড়াই, স্রেফ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ করানো হয়েছে। কোনও প্রতিবাদে কান দেওয়া হয়নি। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনাতেও যে সুপরামর্শ কেন্দ্র কানে নেবে, তেমন আশা ছিল না মোটেই। তবে মিথ্যে প্রচারের মঞ্চ হিসেবে যে ভাবে সংসদকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে শিউরে উঠতে হয়।
চলতি মাসের শুরুর দিকের ঘটনা। সংসদে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনার সময় বলতে উঠেছিলেন বিজেপি সাংসদ রাধামোহন দাস আগরওয়াল। তিনি একটি কাগজ থেকে নানা তথ্য পড়তে থাকেন। তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল চলতি বছরের জুন মাসে মূল্যবৃদ্ধির রাজ্যওয়ারি তথ্য। কোথা থেকে সেসব সংখ্যা পাওয়া গেল. তা না বলে তিনি কেবল সংখ্যার পরে সংখ্যা পড়ে যান। শেষে তিনি ঘোষণা করলেন, তাঁর ওইসব তথ্য থেকে পরিষ্কার, অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেই দরদাম বৃদ্ধি হচ্ছে সবথেকে চড়া হারে।
চলতি ক্যালেন্ডার বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে গড় মূল্যবৃদ্ধি ছিল ৬.৭৯ শতাংশ। দরদাম কোন রাজ্যে কতটা বেড়েছে? তা নিয়ে একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম রাজ্যভিত্তিক তথ্য জোগাড় করেছে। কী দেখা যাচ্ছে সেখানে?
জানুয়ারি থেকে জুলাই, এই সাত মাসে সারা দেশে গড় খুচরো দাম বৃদ্ধি ৬.৭৯ শতাংশ। রাজ্যগুলির মধ্যে সবথেকে উপরে তেলঙ্গানা, সে রাজ্যে খুচরো দাম বেড়েছে ৮.৩২ শতাংশ হারে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গে, ৮.০৬ শতাংশ। এর পরে সিকিম, ৮.০১ শতাংশ। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় খুচরো দর বৃদ্ধি ৭.৭ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৭.৫২ শতাংশ, আসামে ৭.৩৭, উত্তরপ্রদেশে ৭.২৭, গুজরাত ও জম্মু-কাশ্মীরে ৭.২ শতাংশ, রাজস্থানে খুচরো দর বৃদ্ধি ৭.১ শতাংশ। সবথেকে কম দাম বেড়েছে কেরলে, ৪.৮ শতাংশ হারে। কমের দিকে এর পরে রয়েছে তামিলনাড়ু ৫.০১, পাঞ্জাব ৫.৩৫, দিল্লি ৫.৫৬ ও কর্ণাটক ৫.৮৪ শতাংশ। মাঝামাঝি অবস্থানে যে রাজ্যগুলি রয়েছে সেগুলির মধ্যে অন্ধ্র প্রদেশ ও ঝাড়খণ্ডে দাম বেড়েছে ৬.৯ শতাংশ হারে, বিহারে ৬.০৭, ছত্তীশগড়ে ৬.৪ শতাংশ, উত্তরাখণ্ডে সাড়ে ছয় শতাংশ এবং ওড়িশায় ৬.৬ শতাংশ।
এই হিসেবে এটা পরিষ্কার, ৭ শতাংশের উপর খুচরো দাম বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুলি বিজেপি শাসিত রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত এলাকায়, যেমন উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, জম্মু-কাশ্মীরে। অ-বিজেপি শাসিত যে-সব রাজ্যে চড়া হারে দাম বেড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে তেলঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান প্রভৃতি। বিজেপি সাংসদের মিথ্যাচার যে এতটা ন্যক্কারজনক হতে পারে, ভাবাই যায় না। দাম বৃদ্ধির বিপদ মাথা চাড়া দিয়েছে মোদি সরকারের ব্যর্থতাতেই। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির বড়বড় দাবি যখন বাতাসে মিলিয়ে যায়, দেখা দেয় দারুণ মূল্যবৃদ্ধি। ২০১৯ সালে এ দেশে খুচরো দরদাম বৃদ্ধি হয়েছিল ৩.৭৩ শতাংশ হারে। ২০২০-তে ওই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬.৬২ শতাংশ। এদিকে লক-ডাউনের ধাক্কায় কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হন, চাহিদা কমে যায়। চাহিদা কমায় ২০২১ সালে দাম বাড়ার হার কিছুটা কমে হয় ৫.১৩ শতাংশ। তারপরই ধারাবাহিক ভাবে বাড়তে থাকে জিনিসপত্রের দরদাম।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে খুচরো দাম বৃদ্ধির হার ছিল ৬.০১ শতাংশ, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি ছিল ১২.৯৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ওই দুই হার আরও বেড়ে হয়েছিল ৬.০৭ ও ১৩.১১ শতাংশ। এপ্রিলে ৭.৭৯ ও ১৫.১০ শতাংশ। মে মাসে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি ছিল ৭.০৪ শতাংশ, পাইকারি দাম বাড়ে ১৫.৮৮ শতাংশ। জুনে খুচরো দাম বেড়েছে ৭.০১ শতাংশ ও পাইকারি দাম বৃদ্ধি ১৫.১৮ শতাংশ।
ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পরে টনক নড়ে মোদি সরকারের। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট বাড়াতে শুরু করে। মে মাসে ৪০ বেসিস পয়েন্ট বা ০.৪০ শতাংশ, ৮ জুন ২০২২-এ ৫০ বেসিস পয়েন্ট বা ০.৫০ শতাংশ। জুলাইতেও দাম নিয়ন্ত্রণে আসেনি। চলতি বছরের জুলাইতে খুচরো দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬.৭১ শতাংশ হারে, ওই মাসে পাইকারি দাম বেড়েছে ১৩.৯৩ শতাংশ হারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পদক্ষেপে দরদাম নিয়ন্ত্রণে আসার কোনও লক্ষণ দেখা না দেওয়ায় আবার ৫ অগাস্ট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বা ০.৫০ শতাংশ বাড়ানো হয় রেপো রেট। ওই হার ৪ থেকে বেড়ে হয় ৫.৪০ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি রুখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তিন দফায় রেপো রেট বাড়িয়েছে ১৪০ বেসিস পয়েন্ট বা ১.৪০ শতাংশ। এর ধাক্কায় ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণে সুদ ক্রমাগতই বাড়ছে। সাধারণ মধ্যবিত্ত বা গরিব মানুষও ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেন। তাঁদের গুণতে হচ্ছে অনেকটাই বাড়তি সুদ।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, বারবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট বাড়ালেও বাড়ছে না ব্যাঙ্কে জমার সুদ। স্থায়ী আমানতে যেটুকু সুদ মিলছে তা মূল্যবৃদ্ধির হারের থেকে অনেকটাই কম। দরদাম বৃদ্ধিতে এমনিতেই নাজেহাল আমজনতা। তার উপর সুদ নির্ভর মানুষ, বিশেষ করে প্রবীণ নাগরিকরা পড়েছেন বিরাট সমস্যায়। প্রশ্ন উঠছে, কোন কারণে আটকে যাচ্ছে আমানতের সুদ বৃদ্ধি?
দাম কমাতে পদক্ষেপ করতে হবে কেন্দ্রকেই। মূল যে কারণগুলিতে এ দেশে দাম বাড়ছে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয় হলো পেট্রোল ডিজেল রান্নার গ্যাসের দাম বাড়া। জ্বালানিতে ভরতুকি প্রায় তুলেই দিয়েছে কেন্দ্র। ডিজেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে পরিবহণের খরচ, সেই চাপটা পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। কিছুদিন আগেই প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম দারুণ ভাবে বাড়িয়েছে কেন্দ্র। বারবার রেপো রেট বেড়ে যাওয়ায় ঋণের খরচ বেড়েছে, বেড়েছে উৎপাদনের খরচ। সেই চাপও এসে পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপরে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম ক্রমাগত পড়ে যাওয়ায় খরচ বাড়ছে আমদানির। সে কারণেও বাড়ছে জিনিসের দাম। এরকম আরও নানা দিক তুলে ধরা যায়। এসবই কেন্দ্রের বিষয়। এছাড়া রয়েছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতি, যার ফলে জোগান শৃঙ্খলে চাপ পড়ছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে।
রাজ্যগুলির কিছুই করণীয় নেই, তা কিন্তু নয়। কালোবাজারি, মজুতদারি রুখতে পদক্ষেপ করা দরকার। সরকার নিয়ন্ত্রিত দামে কিছুদিন সবজি সহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রির ব্যবস্থা করলে দাম কমতে পারে। অতীতে এমন পদক্ষেপ বারবার এ রাজ্যে করা হয়েছে। আশা করা যায়, আবার বড় আকারে তেমন পদক্ষেপ দেখা যাবে এ রাজ্যেও।