কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: অগ্নিপথে ‘অগ্নিপথ’। গোটা দেশ জ্বলছে। ট্রেনে-বাসে পাথর ছোড়া, আগুন লাগানো চলছে। পুলিসের গুলিতে একজনের মৃত্যু, একজন আত্মহত্যা করেছেন। শ্রীনগর থেকে শ্রীরঙ্গপত্তনম, কচ্ছ থেকে কাছাড়— দেশের লাখো বেকার এখন রাস্তায়। তাদের উন্মত্ত তাণ্ডবে সাধারণ মানুষ ঠান্ডাঘরে বসে নিন্দার ঝড়ে হাওয়া গরম করছেন। কিন্তু, এই আন্দোলন উন্নয়নের ঠুলি আঁটা বিজেপির চোখে কঠিন বাস্তবের জল ছিটিয়ে দিয়েছে। বেকারি দূরীকরণ ও নয়া নয়া চাকরি সৃষ্টির জাদুকর মোদির জাদুছড়ির ক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে দেশের তামাম যুবসমাজ। আর সেটা হল, উচ্চশিক্ষিত দুধের সরের মতো যুবসমাজ নয়, স্বল্পশিক্ষিত কর্মহীন বেকারের সংখ্যা কত? এতদিন মোদি-বাহিনী দেশের জনতাকে কীভাবে বুরবাক বানিয়ে রেখেছিল! এই আগুনের প্রতিটি শিখা আজ সেই মিথ্যার বেসাতিকে জ্বালিয়ে খাক করে দিচ্ছে।
প্রয়াগরাজের নওজওয়ান সুমিত গৌতমের তিনটি স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে। তাছাড়াও তিনি আইন পাশ করেছেন। কিন্তু, তাঁর এখনও কোনও চাকরি জোটেনি। তাঁর মতোই এরকম লাখো যুবক বাবা-মায়ের রক্তঝরানো টাকা খরচ করে পড়াশোনা করেছেন। বাবা-মাসহ তাঁদেরও চোখে একটাই স্বপ্ন ছিল, পড়ার শেষে একটা চাকরি, নিদেনপক্ষে একটা ভদ্রস্থ কাজ জুটবে। কিন্তু, চাকরির ইঁদুর দৌড়ে ছুটেই চলেছেন সকলে। খালি হাতে, খালি পায়ে। ঘাম ঝরছে, রক্ত ঝরছে— কিন্তু চাকরি নেই। সেই ক্ষোভই আগুনের বহিঃপ্রকাশ। ঠান্ডা মেশিনের হাওয়ায় সেই উত্তাপের আঁচ পাওয়া কঠিন।
আরও পড়ুন: Abhishek Banerjee: ২১ জুলাইয়ের জন্য চাঁদা তুললেই বহিষ্কার, কড়া হুঁশিয়ারি অভিষেকের
আজকের ভারতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি হল একটি গবেষণা তথা জাতীয় অর্থনীতিকেন্দ্রিক চিন্তাবিদ সংস্থা। তাদের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে প্রতি ৫ জন কলেজ পাশ করা স্নাতকের মধ্যে একজন কর্মহীন। কলেজ পাশ করা এই বেকার যুবকদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক চরম হতাশা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এটার নাম দিয়েছে, যুবদের মধ্যে মোহভঙ্গতা ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে ভারতের অর্থনীতিতে এক বিরূপ প্রভাব পড়বে। বৃদ্ধি পাবে চলতি চাকরি বাজারের সংকটের।
উদাহরণ টেনে বলা যায়, যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, তাঁদের যেমন কাজের নিশ্চয়তা নেই। বয়স শেষে তাঁরা তাঁদের পরিবারকে যেমন ভবিষ্যতের সুরক্ষা দিতে অক্ষম, তেমনই দশা এ দেশের যুবসমাজের। পড়াশোনা আছে, পরীক্ষায় পাশ আছে— কিন্তু চাকরির বেলায় লবডঙ্কা। লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে…এই ছড়া হয়তো আগামিদিনে বাবা-মায়েরাও ভুলে যাবেন। কিংবা ভুলেও ছেলেমেয়েকে শেখাবেন না। এখানেই শেষ নয়, শিক্ষাদীক্ষার মানের জলাঞ্জলি দিয়ে যদিওবা বেসরকারি কাজ জুটে যায়, সেখানেও বেতন অনেক সময়ই দিনমজুরির থেকেও কম। নেই কোনও স্বাস্থ্যবিমা কিংবা চাকরির সুনিশ্চয়তা।
কিছুদিন আগেই রেলের কেরানি পদে ৩৫ হাজার চাকরিতে ১ কোটি ২০ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছিল। বিজ্ঞাপনে যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছিল, তা বদল করায় গয়ায় একটি ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতি এই মোহভঙ্গতার কারণেই এখন দিকে দিকে আগুন জ্বলছে। আর তার তীব্রতা কোথায়! মূলত বিহার ও উত্তরপ্রদেশে। যে দুটি রাজ্যেই অপুষ্টি বেশি, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার বেশি এবং জীবনের প্রতি হতাশাগ্রস্তের সংখ্যা বেশি।
যেমনটা বললেন ২৩ বছরের সর্বেশ ধোবি। তাঁর কথায় এখনকার দিনে একটা চাকরিতেই স্থিরতা ও নিরাপত্তা আছে, আর সেটা সরকারি চাকরি। সর্বেশ কমিউনিকেশনে স্নাতকোত্তর করেছেন। দিল্লির ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ঋতিকা খেরা বলেন, এদেশের শ্রম আইন এতটাই দুর্বল যে, বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরি করা যুবকরা রাতদিন অনিশ্চয়তা ভোগেন।
একদিকে হাতে গোনা সরকারি চাকরি। অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিতে অস্থিরতা। সব মিলিয়ে যুব সমাজকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন ১ কোটি ৭০ লক্ষ যুবক চাকরি খুঁজছেন। কিন্তু তাঁদের বেশিরভাগই চাকরি জোগাড়ে অতিসক্রিয় নন, এই হতাশাই তাঁদের পিছিয়ে দিচ্ছে। তাঁদের অনেকেই বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরি করেও ছেড়ে দিয়েছেন বা দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, কম বেতনে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম।
এই সবেরই ফলশ্রুতি হল এই গন্ডগোল। যাঁরা অন্তত কলেজ পাশ করেছেন, কিংবা তারও বেশি পাশ দিয়েছেন, তাঁরা সরকারি চাকরির স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের সুরক্ষা চাইছেন। সরকার তাঁদের কথা শুনছে না। এবার সরকারের বন্ধ চোখ-কান খোলাতে তাই রুদ্রমূর্তি ধরেছেন কর্মহীনরা। মোদি এখন বাধ্য হতাশা ও মোহভঙ্গের শব কাঁধে নিয়ে বেকারদের এই তাণ্ডবনৃত্য দেখতে। আর চোখ বুজে থাকলে চলবে না।