একদা এই বাংলার রাজ্যপাল সৈয়দ নুরুল হাসান আর সিপিএম জমানার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে এক কিউট সিমিলারিটি ছিল। তাঁদের বিশাল বপুই কেবল নয়, তাঁদের শিশুসুলভ হাসিও বেশ লাগত। সৈয়দ নুরুল হাসান তাঁর হাসি অমলিন রেখেই গত হয়েছেন, কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখ থেকে সেই হাসি উধাও হয়েছিল বহুদিন। ‘শরীরটা ভালো নেই’ বলার সেই অসহায় উচ্চারণের পাশেই রাশি রাশি বান্ধবী আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, সম্পত্তি আর দুর্নীতির মধ্যে সে হাসি হারিয়ে গিয়েছিল। মন্ত্রিসভারই নয়, তৃণমূল দলেরও দু’ নম্বর নেতাকে দেখলেই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া নজরুলের গান মনে পড়েছে বার বার— চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়/ আজিকে যে রাজাধিরাজ কা’ল সে ভিক্ষা চায়। কাহারও সমান নাহি যায়। কিন্তু শোক, দুঃখ, অপমান, লজ্জা ইত্যাদি অনুভূতির একটা শেলফ লাইফ আছে, মানে কিছুদিন পরেই এইসব অনুভূতির এক্সপায়ারি ডেট এসে যায়। লজ্জা পেতে পেতে, অপমানিত হতে হতে একটা সময় সে বোধ চলে যায়, চলে যেতে বাধ্য। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ লিখেছিলেন শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মামা, তো সেই ভাগ্নে ইডির গাড়িতে উঠছেন, অ্যারেস্ট হচ্ছেন, ঘর থেকে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বের হচ্ছে, বান্ধবীর বাড়ি থেকে রাশি রাশি টাকা। তাঁকে লজ্জিত দেখাচ্ছিল, ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল, এক অপমান জুড়ে ছিল সর্বাঙ্গে, কোনওক্রমে বলছিলেন শরীরটা ভালো নেই। সেই তাঁর অপমান, লজ্জা, ভয় ইত্যাদি বোধগুলোর এক্সপায়ারি ডেট পার করে গেছে। সেসব চুলোর দোরে পাঠিয়েই তিনি আদালতে এসে বান্ধবীকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিচ্ছেন, হাসছেন, হাত নাড়ছেন, পাশ থেকে ভজাদের দল পার্থদা জিন্দাবাদ বলছে, উনি আমোদিত। আজ আবার রবিঠাকুরের কবিতা নিজের মতো করেই আউড়ে দিলেন। গতকাল জেল লাইব্রেরিতে পড়েছেন, আজ পুরোটা মনে ছিল না, কিন্তু আউড়ে দিলেন, বললেন, মসি লিপি দিল ইত্যাদি। আজ সেটাই বিষয় আজকে।
আদতে কবিতাটা কী ছিল? রবিঠাকুরের লেখা সোনার তরীর কবিতায় সেই রূপকথার গল্প। রানি দর্পণকে জিজ্ঞেস করছেন, বল তো বিশ্বের সেরা সুন্দরী কে? মায়া দর্পণ রানিকে জানাল, সেরা সুন্দরী হলেন বিম্ববতী, সতীনের মেয়ে। রানি বিম্ববতীকে বিষ খাওয়াল কিন্তু মায়া দর্পণে সেরা সুন্দরীর নাম তো গাঁথা হয়ে গেছে, সেরা সুন্দরী তো বিম্ববতী। এইখানে এসে রবি ঠাকুর লিখছেন, মসী লেপি দিল তবু ছবি ঢাকিল না/ অগ্নি দিল তবুও তো গলিল না সোনা। কালি লেপে দেওয়ার পরেও বিম্ববতীর ছবি মোছা গেল না, আগুনে দেওয়ার পরেও না। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় রবি ঠাকুরের জন্মদিনের আগেই মাত্র দু’ লাইন শুদ্ধ কবিতাও আউড়ে উঠতে পারলেন না, লেপি হয়ে গেল লিপি, বাক্য তার মানে হারাল। যদিও এটা স্বীকার করতেই হবে যে ওনার মুখ থেকে যাবতীয় মান অপমান লজ্জা মুছে গেছে। কিন্তু সে তো এমনি এমনি হয়নি। এমনি এমনি কিছুই হয় না। আজ হঠাৎ তৃণমূলের নবদিগন্তে জনজোয়ার দেখতে পাচ্ছেন, জেলখানাতেই বসেই দেখতে পাচ্ছেন, তার তো কিছু কারণ আছে। আসুন সেই কারণটা বুঝে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: Aajke | তৃণমূলের শুদ্ধিকরণ সম্ভব?
এই ক’দিন আগেই সিবিআই এক মুখবন্ধ খামে তাদের তদন্তের রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছে, তা ইতিমধ্যেই সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে, আমরা সে রিপোর্ট অন্য অনেকের আগেই আপনাদের জানিয়েছিলাম। সেই রিপোর্টে মানিক ভট্টাচার্য এবং ওই সৎ রঞ্জন ইত্যাদি কিছু শাগরেদকে এই দুর্নীতির মাথায় বসিয়েছে সিবিআই। কিন্তু শেষে এসে সাফ জানিয়েছে যে এই দুর্নীতি কোনওভাবেই সম্ভব হত না যদি না রাজ্য সরকার, মন্ত্রিসভা, ক্যাবিনেট মানিক ভট্টাচার্যকে পরের পর, পরের পর মেয়াদ বাড়িয়ে ওই পদেই রেখে দিত। রিপোর্টের শেষে সিবিআই সাফ বলেছে কাজেই এই দুর্নীতিতে রাজ্য সরকার এবং রাজ্য প্রশাসনের বড় ভূমিকা আছে। অর্থাৎ পার্থ চট্টোপাধ্যায় একা নন, আঙুল গোটা মন্ত্রিসভার দিকে যেখানে বসে আইনে রদবদল এনেই মানিক ভট্টাচার্যের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেটাই আপাতত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের খানিক স্বস্তির কারণ, তিনি একলা নন, তিনি একলাই চুরি করেননি, এই দুর্নীতির জন্য সিবিআই গোটা মন্ত্রিসভাকেই দায়ী করেছে। কাজেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় আরও বেশি করে তৃণমূল হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, তৃণমূলের দু’ নম্বর নেতার প্রশংসা করছেন রোজ, নবজোয়ারে জনজোয়ার দেখছেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, উনি দলের আশ্রয়ে নিজের দুর্নীতি ঢাকার চেষ্টা করছেন। সমস্যা হল দুর্নীতির প্রাথমিক অভিযোগের পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সমস্ত পদ থেকে সরানো হয়েছে বটে, কিন্তু সেই অর্থে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। আর দুর্নীতির এই শিরোমণিদের দল থকে না তাড়িয়ে নতুন তৃণমূল গড়া কি সম্ভব? মানুষ কী বলছেন?
হ্যাঁ, দুর্নীতি সর্বত্র, রাজনীতিতে দুর্নীতির প্রধান কারণ হল নির্বাচনে কোটি কোটি টাকার খেলা। শোনা যাচ্ছে কর্নাটকে এক একজন প্রার্থী পিছু ৩৫-৫০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, সব দলের। তো এই সমাজসেবীরা নির্বাচিত হয়ে এসে নিজেদের ইনভেস্টমেন্ট-এর ১০-১৫ গুণ তো কামাবেন। সেটাই চলছে। কিন্তু দুর্নীতির ছবি সামনে আসার পরে এইসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোকে দল থেকে তাড়ালে মানুষ খানিক স্বস্তি পায়। যে দুর্নীতিগুলো খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে সেসব দুর্নীতির মাথারা দলেও থাকবে আবার দলের শুদ্ধিকরণও হবে, নতুন তৃণমূল গড়ে উঠবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ আছে কি? মানুষ তো এত বোকা নয়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় রবিঠাকুরের কবিতা আওড়াবেন, আর মানুষ হাসিমুখে শুনবে তা তো হয় না। আজ ওই আদালত থেকে বের হতেই কিছু মানুষ জড়ো হলেন, চিৎকার করলেন চোর চোর চোর। পার্থ শুনেছেন নিশ্চয়ই, অভিষেক, নতুন দল গড়ার কাণ্ডারি, তিনি কি শুনেছেন?