পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ, হাতে গরম ফলাফল। প্রথমত এই নির্বাচনের লড়াইয়ের চরিত্রটা বুঝে নিন, বিজেপির একখানা গাড়ি, তিনটে ঘোড়ায় টানছে, মাথা তিনটে তিন দিকেই চলে, সংগঠন বলে কিছুই নেই। কাজেই যা ফলাফল, তা খুব যে চমকে দেওয়ার মতো তাও নয়। কাঁথির খোকাবাবু নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে হেরেছেন ১০ হাজারের বেশি ভোটে, পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা পরিষদের ফলাফল তৃণমূল ৫৬, বিজেপি ১৪। এ জেলায় দুটো লোকসভা আসন আছে, কাঁথি, তমলুক, হিসেব করলে দুটোতেই বিজেপি পিছিয়ে। ওদিকে দক্ষিণ দিনাজপুরের সাংসদ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, ২১টার ২১টা জেলা পরিষদ আসনেই তৃণমূল জিতেছে। অন্য ঘোড়াটি হলেন দিলীপ ঘোষ, তাঁর বুথেও হেরেছেন, তাঁর সাংসদ এলাকার মধ্যে যেটুকু গ্রামীণ এলাকা আছে তাও ডুবেছে। তিন ঘোড়ার জুড়িগাড়ির তিনমুখো যাত্রার ফলে যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। পরের গাড়ি হচ্ছে এক্কেবারে উল্টোমুখো দুই দলের জোট কিন্তু জোট নয় গোছের একটা জোট, বাম-কং জোট। মূলত বামেদের বিস্তর ভোট গিয়েছিল রামে, ১৪ বছর কাটার আগেই সেসব ভোটের এক অংশ ফিরেছে বামে, অধীর চৌধুরী বিস্তর হল্লাবাজি করে কিছুটা হলেও ভোট বাড়িয়েছেন, অন্তত বিধানসভার থেকে তো বেড়েছে। কিন্তু তা দিয়ে নিজের আসন বাঁচানো যাবে? মালদার আসন বাঁচানো যাবে? হিসেব বলছে না, হিসেব মিলছে না। অন্যদিকে আমরা বহুকাল ধরেই জানতাম তৃণমূলের পোস্ট একটাই, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট, এখন সেই পোস্ট মমতা ব্যানার্জির পাশের মুখ ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও এখন আরেকটি পোস্ট। অর্থাৎ এর আগের তৃণমূলের একটা পোস্টের তত্ত্ব কিন্তু বাতিল করতেই হবে, এই নির্বাচনের পরে দ্বিতীয় পোস্টটিও হাজির। এবং দলের তৃতীয় সারির ঝগড়া অনেকটাই সামাল দিয়েছেন শীর্ষ নেতারা। যদিও এক্কেবারের তলার সারিতে লড়াই, মারপিট, এমনকী খুনোখুনিও হয়েছে। কাজেই ফলাফল দুর্দান্ত, আক্ষেপ একটাই, যদি অশান্তি খানিক সামলানো যেত, যদি খুনোখুনি না হত, বা এতটা না হত, তাহলে এই জয় আরও অনেক অর্থবহ হত এ রাজ্যে নয়, এ রাজ্যের বাইরেও।
এবার আসুন এই ফলাফলের তাৎক্ষণিক প্রভাব আর ২০২৪-এর লোকসভার নির্বাচনের উপর প্রভাব নিয়ে আসল আলোচনাটা করা যাক। প্রথমটা হচ্ছে তাৎক্ষণিক প্রভাব। দেশজোড়া মিডিয়াতে হিংসা খুন জখমের কথা বলার পরেও বলা হচ্ছে, মমতা নে বিজেপি কো তগড়া ঝটকা দিয়া, বলা হচ্ছে বংগাল মে বিজেপি কো শিকস্ত। ক’দিন পরেই বেঙ্গালুরুতে বিরোধী দলের বৈঠক। ওখানে তো অধীর চৌধুরী থাকবেন না, থাকবেন সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গে। বলাই বাহুল্য যে ওই বৈঠকে মমতা যাবেন এক বিরাট সমর্থনের ঝুলি নিয়ে। বিরোধী ঐক্য কেন? বিজেপিকে হারাতেই তো? এই বাংলায় বিজেপিকে হারাতে পারেন কে? উত্তর, মমতা। সেই সামর্থ্য নিয়েই মমতা বৈঠকে বসবেন। খেয়াল করুন রাজনৈতিক চাপের খেলায় তিনি এক কদম এগিয়েই আছেন, বলেছেন দিল্লিতে ঐক্য হবে আমিও চাই, কিন্তু বদলে নৈবেদ্য দিতে হবে না, দুব্বো ঘাস তো আমাদের প্রাপ্য। বিজেপিকে হারানোর জন্য বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে বৈঠকে কংগ্রেসের কাছে, বিরোধী দলগুলোর কাছেও মমতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়েই থাকলেন। এই ভোটেই যদি উনি তিন চারটে জেলা পরিষদ হারতেন, যদি ভোট পার্সেন্টেজ কমে যেত, যদি স্পষ্ট হত যে মুসলমান ভোট ওনার কাছ থেকে সরছে, যদি প্রমাণ হত উনি ওনার নিজের শক্তিতে বিজেপিকে হারাতে পারবেন না, তাহলে ছবিটা ঠিক বিপরীত হত।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ২০২৪-এ বিজেপির ভরসা এখন কংগ্রেস
ক্রমাগত ইডি হামলা, বিভিন্ন এজেন্সির হামলার পরে, দুর্নীতির ভূরি ভূরি অভিযোগ আনার পরেও তৃণমূলের এই জয় বিজেপির ওই ইডি হানা, সিবিআই হানাকে খানিক ভোঁতা করে দিল। এবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইডি ডাকলে উনি বিজেপির বিরুদ্ধে যা যা বলবেন, সবটাই মানুষের কাছে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে। ইডি সিবিআই-এর কর্মকর্তারাও রাজনীতি বোঝেন, ভালোই বোঝেন, জমানা বদলানোর আশঙ্কা কি তাঁদের মাথাতে নেই? কাজেই সেখানে গতি শ্লথ হতে বাধ্য। তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে বিজেপির কর্মীবাহিনীর উপরে। ২০২১-এ নেতাদের বাওয়াল শুনে জান কবুল বলে মাঠে নেমেছিলেন, মার খেয়েছেন, ঘর ভেঙেছে। খানিক সামলে আবার ভোকাল টনিক খেয়ে মাঠে নেমেছেন, আবার হার, বিরাট হার। ২০২৪-এর ডাকে এই বাহিনী মাঠে নামবে তো? এবং এরপরে বিজেপির নবনির্বাচিত পঞ্চায়েতের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি শুধু নয়, এখনও অবশিষ্ট বিজেপি বিধায়কদের মধ্যেও অনেকেই লাইনের ধারে বসে আছেন উন্নয়ন যজ্ঞে ঝাঁপ মারার জন্য, ক’দিন অপেক্ষা করুন, দেখতে পাবেন, সেই এক্সোডাস রোখার মতো সাংগঠনিক জোর বা কাঠামো বিজেপির নেই। যেখানে দলের অন্যতম লড়াকু মুখ শুভেন্দু মাইতি নিজেই বলে ফেলেন, ওসব দল ফল বুঝি না, দলের পতাকা ছেড়েও আমি বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে মমতার বিরুদ্ধে লড়তে রাজি। চরম ফ্রাস্টেশন থেকেই তিনি এ কথা বলেছেন, তাঁর মনে হয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচিত রাজ্য সরকার ভেঙে দিয়ে ওনাকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসাবেন। উনি নিজের আসনেই ১০ হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে, কাঁথি তমলুক জেতাতে পারবেন তো? যেখানে বিপুল ভোটে পিছিয়ে আছেন তাঁর পিতাশ্রী, ভ্রাতাশ্রী। আবার কেলো কি একটা? সেখানে যদি তৃণমূল কুণাল ঘোষকে প্রার্থী করে দেয়, হয় বাঘ ষাঁড়কে খাবে, নাহলে ষাঁড়ের কাছে বাঘ হারবে, কিন্তু শুভেন্দুকে গোটা নির্বাচন ওই কাঁথি আর তমলুকেই আটকে রাখার ক্ষমতা কুণাল ঘোষের আছে।
নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে হেরেছে বিজেপি, বিরাট ভাবেই হেরেছে, আদিবাসী ভোট, রাজবংশী ভোট চলে গেছে তৃণমূলের দিকে, এবং দেখুন বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি, অনন্ত রায় ওরফে অনন্ত মহারাজকে বিজেপি রাজ্যসভা প্রার্থী করল, এমন তো নয় যে হঠাৎ এই ঘটনা ঘটেছে, হঠাৎই এই বিপুল পরাজয় এসেছে, ওনারা মাস ছয় আগে থেকেই অনন্ত রায়ের সঙ্গে কথা বলছেন, তো এবারে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনন্ত রায় ওরফে অনন্ত মহারাজের ভূমিকা কী ছিল? উনি কি ওনার খাস প্রজাদের বলেননি বিজেপিকে ভোট দিতে? উনি কি ওনার খাস প্রজাদের তৃণমূলকে ভোট দিতে বলেছিলেন? আসলে উনি এবং মিডিয়ার এক অংশ মনে করেন যে রাজবংশীরা ওনার প্রজা। আসলে তা নয়, নয় বলেই ওনার এসব রাজনৈতিক কথায় কেউ কানও দেবে না। কিন্তু ওনার যে পৃথক কোচবিহারের দাবি, তার কথা উঠবেই আগামী লোকসভা নির্বাচনে, এই মমতা, অভিষেক তৃণমূলের নেতারাই কেবল নয়, কংগ্রেস সিপিএম-এর নেতারাও বলবেন, বাংলাকে ভাগ করার চক্রান্তে নেমেছে বিজেপি। এটা নির্বাচনের ইস্যু হলে নিশীথ প্রামাণিক হয়তো, হয়তো তাঁর আসন ধরে রাখলেও রাখতে পারেন, ওই দিনাজপুর থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত একটা আসনেও দ্বিতীয় স্থানেও আসতে কষ্ট করতে হবে বিজেপিকে।
এই পঞ্চায়েত নির্বাচন আমাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিল, দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসী ভোট আবার তৃণমূলের ঝোলাতেই ফিরেছে। উত্তরবঙ্গের ছবিটাও একই রকম, সেখানেও আদিবাসী ভোট ফিরেছে তৃণমূলে। আমাদের বাংলাতে লোকসভার আসনের ৯টা আসনে এই আদিবাসীরাই নির্ণায়ক, এই ৯টা আসনের অধিকাংশই বিজেপির দিকেই ছিল, এবার সেখানেও বিজেপি হারবে। মুসলমান ভোটের আলোচনার শুরুতেই বলি, যেখানে তৃণমূল হারলেও বিজেপি নয় কংগ্রেস জিতে যাবে, এরকম একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল, সেখানে মুসলমানদের এক অংশের ভোট কংগ্রেসের দিকে গেছে, কিন্তু সেটা জেলা পরিষদ লেভেলে নয়, কাজেই লোকসভার নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে মুসলমানদের ভোট একতরফা তৃণমূলের দিকেই যাবে। আনিস খানের মৃত্যু বা বগটুইয়ের ঘটনা কিছুদিনের জন্য আলোড়ন তৈরি করছিল, কিন্তু তা ভোটে বিরাট প্রভাব ফেলেনি, বগটুইয়ের গ্রাম পঞ্চায়েতও তৃণমূলের দখলে, ওদিকে আনিস খানের দাদা বা মামা নির্বাচনে জিততে পারেননি। দেশজোড়া আরএসএস–বিজেপির আগ্রাসী হিন্দুত্ব, তীব্র মুসলমান বিরোধিতা বাড়ছে, সমান্তরাল ভাবে বাড়ছে মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক, ভয়। কাজেই তাঁরাও তাঁদের রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগের সময় কেবল একটাই হিসেব কষছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে কে জিতবে? তৃণমূল এ বাংলায় সেই কারণেই মুসলমানদের ভরসা, ওই ক’টা মোল্লাদের ক’ পয়সা খয়রাতির বদলে নয়, অস্তিত্বের লড়াইয়ে মুসলমানেরা শত্রু আর বন্ধু চিনতে ভুল করছেন না। ভোটের পার্সেন্টেজটা দেখুন, বাম কংগ্রেস ৫ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশে এসেছে, বিজেপি ৩৭ শতাংশ থেকে কমে ২৩ শতাংশ, তৃণমূল ৫১ শতাংশ। মজার কথা হল বিজেপির ভোট কমেছে ১৪ শতাংশ, বাম-কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ১৪ শতাংশ। ক্রমশ ক্লাসিকাল ট্রায়াঙ্গুলার ইলেকটোরাল ফাইটের মধ্যে চলে আসছে আমাদের বাংলা। আগামী লোকসভা নির্বাচনে যা আরও পরিষ্কার হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল ৪৭-৪৮ শতাংশ ভোট পেল, বিজেপি খুব জোর হলে ওই ২৫-২৬ শতাংশ ভোট পাবে, বাম কংগ্রেস, ১৯-২০ শতাংশ ভোট পাবে। এটা আমাদের ধারণা, এবং যদি তাই হয় তাহলে এই বাংলাতে বিজেপি ১-২ আসন, কংগ্রেস ১টা আসন পাবে, বাকি ৩৯-৪০টা আসন কিন্তু তৃণমূলের কাছেই থাকবে। হ্যাঁ, ৩৫টা আসনের খোয়াব ভুলে যান নাড্ডাজি, অমিত শাহজি, ১-২টো আসন পেলেও বুঝবেন বিরাট পাওয়া হয়েছে। ২০২৪ সাল আর যাই হোক মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন না।