মনে আছে আমার, আপনাদেরও মনে আছে নিশ্চয়ই, অব কি বার ট্রাম্প সরকার। একজন অবিবেচক কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত ধরে স্লোগান দিচ্ছেন, তাও আবার ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে। ওদিকে বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তখন দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই স্লোগানের খবর তো তাঁর কানেও পৌঁছেছিল। তাতে কী? আমেরিকার লক্ষ্য হল তাদের দেশের স্বার্থ, তাদের দেশের সুরক্ষা, তাদের দেশের বাণিজ্য এবং এসব কিছুর সঙ্গে প্রোটোকল, সৌজন্য, রীতিনীতি ভেঙে হঠাৎ কিছু বলে দেওয়া তাদের ধাতে নেই। একজন স্ট্রিট স্মার্ট লোক অনায়াসে না ভেবেই কিছু বলে ফেলতে পারে, আমরা সেই ধাঁচ দেখেছি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে, দেখেছি ব্রাজিলের বলসেনারোর মধ্যে, টার্কির এর্ডয়ানের মধ্যে এবং অবশ্যই আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদির মধ্যে। অতএব এক বিরাট বাজারের কর্তা যখন আমেরিকা যাচ্ছেন, তখন আমেরিকানরা, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি তাঁকে যে সাদর অভ্যর্থনা জানাবেন, এ আর নতুন কী। তবে কেবল বাজারই নয়, আরও কিছু বিষয় আজ গোটা পৃথিবীর জিও পলিটিক্যাল, ভূরাজনৈতিক মানচিত্রকে বদলে দিচ্ছে, আজ তা নিয়েই কিছু আলোচনা করব। কিছুদিন আগে পর্যন্তও সারা পৃথিবীর মূল দ্বন্দ্ব দাঁড়িয়েছিল ইসলামিক টেররিজম এবং আমেরিকা, ইউরোপীয় গণতন্ত্রের সম্পর্কের উপর। অন্তত সেটাই আমেরিকা বা ইউরোপ বোঝাতে চেয়েছিল। যে ধারণা ভিত্তিহীনও ছিল না। পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যে সন্ত্রাসবাদের জাল ছড়িয়ে ছিল, তা বিশ্বের অন্য অংশকে ভাবাতে শুরুই করেছিল যে এই সন্ত্রাস শেষ না হলে পৃথিবী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আমেরিকা, ইউরোপ এই ইসলামিক সন্ত্রাসবাদকে সামনে রেখে নিজেদের ঘর গুছিয়েছে, পাকিস্তানকেও অস্ত্র বেচেছে, ভারতবর্ষকেও বেচেছে।
কিন্তু যা হয়, সন্ত্রাসবাদের এক ফ্যাটিগনেস আছে, সন্ত্রাসবাদীরাও ক্লান্ত হয়, কাজেই একটা সময়ের পরে কেবল ওসামা বিন লাদেন বা ওই রকম কিছু মানুষ মারা গেল বলেই নয়, আদতে মানুষ বাঁচতে চায় বলেই সন্ত্রাস একেবারে বন্ধ হয়নি, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকিয়ে দেখুন, উল্লেখযোগ্যভাবেই কমেছে। যে সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডন ইত্যাদি দেশগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করত, সেই মধ্যপ্রাচ্য এখন ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে চাইছে, এটা স্বাভাবিক। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেল বেচে বিপুল রোজগার করছে, টাকাটা ঢালবে কোথায়? প্রতি বছরে সরকার পাল্টাতে থাকা সেনা নির্ভর পাকিস্তানে তো নয়, তারচেয়ে তাদের অনেক বেশি পছন্দ প্রায় ২৫ কোটি মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তদের বাজার আমাদের ভারতবর্ষে। এবং এক দ্বন্দ্ব শেষ হয় অন্য দ্বন্দ্বের শুরু হওয়ার জন্যই। আপাতত পৃথিবীতে নতুন দ্বন্দ্বের এপিসেন্টার হল চীন, তার আগ্রাসী বৈদেশিক এবং বাণিজ্যিক নীতি। খুব বেশি দূরে নয়, আমাদের কলকাতা টিভি দফতরের উল্টোদিকে এজরা স্ট্রিটের ইলেক্ট্রিকাল গুডস-এর মার্কেটে চলে যান। খুব চেষ্টা করে এদেশে তৈরি জিনিসপত্র খুঁজে পাবেন। বাল্ব থেকে পুতুল শুধু নয়, বিভিন্ন জিনিস তৈরি করার মেশিনও আসছে ওই চীন থেকে এবং সে সব সস্তায় আসছে। ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক ঘাটতি, ট্রেড ডেফিসিট কত? ২০২২–২৩ এর ১০ মাসেই চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক ঘাটতি ৭১.৫০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। ২০০৪–২০০৫ এ ছিল ১.৪৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩–২০১৪তে, যে বছরে মোদিজি ক্ষমতায় এলেন, সেই বছরে ঘাটতি ছিল ৩৬.২১ বিলিয়ন ডলার আর এখন তা ৭১.৫০ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্যিক ঘাটতি মানে আমাদের দেশ চীনকে যা বিক্রি করেছে, আর চীন আমাদেরকে যা বিক্রি করেছে তার ফারাক। হিসেব বলছে আমরা প্রতি বছরেই চীনের থেকে জিনিসপত্র আমদানি করা বাড়িয়ে যাচ্ছি, অতএব ঘাটতিও বাড়ছে। মোদিজির ভোকাল ফর লোকাল বা মেক ইন ইন্ডিয়া কোনও কাজেই আসছে না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | রাত পোহালেই বৈঠক, আগাম পৌঁছে গেলেন মমতা, বিরোধীদের মুখ কে?
চীন তার অর্থনীতি কত বড় করেছে? তার দুটো প্রমাণ দিই। এই সময়ে চীনের মানুষের মাথা পিছু আয় ১৯১৬০ ডলার, ভারতবর্ষের ২৬০১ ডলার। মানে চীনের মানুষ গড়ে ভারতবর্ষের মানুষের চেয়ে সাত গুণেরও বেশি আয় করে। অন্য উদাহরণটা হল এই ক’দিন আগে বিজেপির এক মুখপাত্র জাতীয় চ্যানেলে বুক ঠুকে বলছিলেন, জানেন আমাদের দেশের অর্থনীতি কোথায় গেছে? এয়ার ইন্ডিয়া সাড়ে চারশো নতুন বিমান কেনার বরাত দিয়েছে, আর এই ক’দিন আগে ইন্ডিগো পাঁচশো বিমানের অর্ডার দিল। একবার গ্রাউন্ড রিয়েলিটিটা জেনে নিই। এই মুহূর্তে ডিজিসিএ-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশের যাত্রীবাহী বিমানের সংখ্যা ৬৯৮, এবার এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো, স্পাইস জেট ইত্যাদি বিমান সংস্থাগুলো মিলে আরও ১১০০ বিমানের বরাত দিয়েছে, তা হুউউউস করে তো আসবে না, ধাপে ধাপে আসবে। মানে আগামী ৪-৫ বছরে আমাদের বিমানের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮০০ র মতো। আর ঠিক এই মুহূর্তে চীনের বিমানের সংখ্যা কত? ৬৭৯৫। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, ৬৭৯৫। এবং তারমধ্যে ৩০ শতাংশ তাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে, আমাদের দেশে একটাও হয় না। আমাদের অর্থনীতি যে হারে এগোচ্ছে তাতে এই ফারাক আরও বাড়বে এবং চীনেও বৈষম্য আছে, ভালরকম আছে, কিন্তু তা আমাদের মতো নয়। তাদের দেশের তস্য গরিব মানুষগুলো খাবারের অভাবে, বাসস্থানের অভাবে মারা যায় না। এ নিয়ে আরেকদিন কথা বলা যাবে, যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম তাতে ফেরা যাক। বিশ্বে চীন এক সুপার পাওয়ার হিসেবে উঠে আসছে। কাজেই আমেরিকা ইউরোপ চীন নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। দুভাবে এই কাজ তারা করছে, এক হল চীনের সঙ্গে কথাবার্তা, আলোচনা এবং বাণিজ্যও চালিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে চীনের বিপরীতে এক বড় কোয়ালিশন তৈরি করা। তারা শিখণ্ডি খুঁজছে, যার আড়ালে থেকে যুদ্ধ করা যায়। আর এই উপমহাদেশে সেই শক্তি ভারতবর্ষের চেয়ে আর ভালো কে-ই বা হতে পারে।
চীনের ভূখণ্ডের সঙ্গে বিরাট সীমান্ত, চীনের সঙ্গে সেই ৬০-এর দশক থেকেই সম্পর্কে টানাপোড়েন এবং তার সঙ্গেই ভারতবর্ষের বিরাট বাজার, সব মিলিয়ে বাইডেন থেকে ম্যাক্রঁ বা ঋষি সুনক বা জার্মানির ওলাফ স্কোলজ মোদিকে ডাকবেন, জড়িয়ে ধরবেন, হ্যান্ডশেক করবেন, পোর্টাবেলা মাশরুম খাওয়াবেন। মোদির বদলে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া হলেও এই অভ্যর্থনায় ব্যত্যয় ঘটত না, একই ভাবে জো বাইডেন এবং তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনিও হাত নাড়তেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিভিন্ন দেশের ক্ষমতা, অর্থনীতি এবং সেই দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর সেই দেশ ও দেশের নেতার গুরুত্ব বাড়ে বা কমে। ধরুন ন্যাটোতেই আছে, ইউরোপেই আছে, অর্থনীতিও ভালো, কিন্তু হল্যান্ড নিয়ে ফুটবল ছাড়া কোনও আলোচনা হয় কি? না হয় না। ধরুন সাজিদ মির, এক আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থী, ২৬/১০-এর ষড়যন্ত্রের অন্যতম মাথা, পাকিস্তানেই আদালতে সাজাপ্রাপ্ত, আমেরিকা তাকে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রেখেছে, কিন্তু চীন এমনকী ইউনাইটেড নেশনস-এও ওই সাজিদ মিরের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী চীনের নাম না করে এই ঘটনার নিন্দা করেছেন, হ্যাঁ নাম করেননি। যে প্রধানমন্ত্রীর সিনা ৫৬ ইঞ্চি, যিনি ক্ষণে ক্ষণে পাকিস্তানকে ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গের মতো হুমকি দিয়ে থাকেন, তিনিই সাজিদ মিরের ক্ষেত্রে চীনের নামই নিলেন না, চীনের সঙ্গে যাবতীয় সীমান্ত বিবাদ আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হতে পারে বলে বিবৃতি দিচ্ছেন কেন? কারণ ওই চীনের অর্থনীতি, তার মিলিটারি পাওয়ার, তার ভৌগোলিক অবস্থান। ঠিক সেই রকমই সেদিন মোদি অবকি বার ট্রাম্প সরকার বলে ট্রাম্প সাহেবের হাত ধরে যতই ঝোলাঝুলি করে থাকুন, জো বাইডেন মোদিকে জড়িয়ে ধরবেন, নৈশভোজে যাবেন এবং ওই আলতো করে বাইডেন একটা প্যাঁচমারা কথা বলেই ছেড়ে দেবেন যে আমেরিকা এবং ভারতবর্ষের মূল নীতি হল ধর্মীয় বহুত্ববাদ। তিনি যখন এই কথা বললেন, তখন তাঁর হয় মনে নেই বা মনে আছে কিন্তু বললেন না যে মোদিজির দলে একজন সংখ্যালঘু সাংসদ নেই, একজন সংখ্যালঘু মন্ত্রীও নেই। উল্টোদিকে প্রভু কি লীলা অপরম্পার, এই প্রথম মোদিজি সাংবাদিক সম্মেলনে দেশে বা বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন নিলেন, উত্তর দিলেন। প্রশ্ন ছিল গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে, তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন সে অভিযোগ বলেননি আমরাই হলাম মাদার অফ ডেমোক্রাসি, উনি জানতেন সে কথা বললে সব্বাই হাসবে। তিনি বলেছেন আমাদের দেশের ডিএনএতেই আছে গণতন্ত্র। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিক সম্মেলনে নির্ভেজাল মিথ্যে না বলে কৌশলের সাহায্য নিলেন প্রধানমন্ত্রী, হ্যাঁ, আমাদের দেশের ডিএনএ-তে আছে তো গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, কিন্তু তা যে আপাতত প্রতি পদে ভুলুণ্ঠিত, সে কথা বললেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। আর একই সময়ে আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা সাংবাদিকদের ডেকেই সাফ জানিয়ে দিলেন, বিশ্বের যে সমস্ত দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার আছে কিন্তু যেখানে তার সঙ্গে আমেরিকার স্বার্থ জড়িয়ে আছে, সেখানে কূটনীতির অঙ্গ হিসেবেই অনেক বিষয়ে আমাদের মানে রাষ্ট্রপ্রধানদের চুপ করে থাকতে হয়, কিন্তু আমরা সত্যিটা জানি না তা তো নয়। এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন দেশকে টুকরো হওয়ার রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। হ্যাঁ মোদি আমেরিকা থাকাকালীনই বারাক ওবামার এই সাক্ষাৎকার বলে দেয়, হাত মেলানো, গলা জড়ানো সবটাই আসলে হয় বাজার না হলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। সমস্যা হল ২১ কোটির হিরে উপহার দিয়েই আহ্লাদে আটখানা মোদিজি এবং ততোধিক খুশি তাঁর ভক্তকুল, এই সত্যিটা কি তাদের উর্বর মস্তিষ্কে ঢুকবে?