অস্ট্রেলিয়া : ৪৬৯
ভারত : ১৫১-৫
স্যাটেলাইট টিভি বহুবছর ধরে এদেশে এত চমৎকার ক্রিকেট কভারেজ করে যে বেচারি প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিককে হাতড়ে বেড়াতে হয় সে নতুন কী পাঠককে পড়াবে ? আর পড়াবে যে উপাদানটাই বা পাবে কোথায় ? আকর্ষণীয় উপাদনের জন্য তাকে তখন খোঁজখাজ তল্লাশি করতে হয় সেই সব সরু গলির যেখানে টিভি ক্যামেরা ঢোকে না।
ওভাল মাঠে কালার কপি লেখার জন্য তেমন একটা গলি বরাবর শচীন টেনডুলকর ব্যাট করতে নামার আগে মাঠের প্রাক প্রতিক্রিয়া। বিশ্বে সব মাঠেই শচীন আদৃত কিন্তু ওভালে সাংবাদিকের বড় সুবিধে জ্যাক হবস গেট থেকে প্রেসবক্স গেট পর্যন্ত যে হাফ সার্কল ,সেখানে ভারতের প্রথম উইকেট পড়া মাত্র আগাম হাঁটাহাঁটি শুরু করলে সে পুরো মেজাজটা পেয়ে যায় । কপাল ভালো থাকলে ওই অর্ধচন্দ্রের মধ্যে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেকে এল এন মিত্তল। আলেস্টার কুক থেকে ভারত থেকে ম্যাচ দেখতে আসা অভিনেত্রী সবাইকে পেয়ে যাওয়া সম্ভব। যদি গণমান্য অথিতিদের কাউকে না-ও পাওয়া যায় ,ওভাল দর্শকদের মেজাজ অনেক বিন্দাস। প্রেস বক্স থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ দেখালে সেই মুড্ ধরে রাখার অবারিত সুযোগ। আর যেমুহূর্তে ভারতের দু উইকেট পড়ল, আকুলতাটা চূড়ান্ত পৌঁছে যেত।
ঠিক লিখলাম না। যেত কেন ? যায়। আজও যায় ভারতীয় চার নম্বর বিরাট কোহলির জন্য। বিশাল ক্যাপটিভ অডিয়েন্স তাঁর এদেশে। শচীনের রুটিন তাই পরবর্তী সময়ে ওভাল ম্যাচ কভারেজে গেলে কোহলির জন্য অব্যাহত রেখেছি। আবেগের এমন সব অভিনব প্রকাশ যে দারুণ কালার কপি করা যেত। টিভিতে শুনছিলাম এদিন শুভমান গিল জাজমেন্ট দিতে গিয়ে বোল্ড হওয়া মাত্র প্রচন্ড চিৎকার শুরু হয়ে গেল। হবেই। কিং কোহলি নামছেন যে। দ্রুত মনে পড়ল ওই গলিতে সফর করলে প্রাক কোহলি আবেগের জোগাড়যন্ত্রর লাইভ স্বাদ পাওয়া যেত। কোনো ভারতীয় সাংবাদিক কি গেল সেই রুটে ?
গিল –ভারতীয় ব্যাটিং সাম্রাজ্যবাদের নতুন খিলান। অথচ তাঁর অতর্কিত বিদায়েও জনতার উল্লাস কমছে না। আর তর সইছে না। তারা স্বপ্নের নায়ককে এখুনি বাইশ গজে দেখতে চায়। কিন্তু ৪৬৯ তাড়া করে এই পিচে অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দেওয়া বিরাটের আয়ত্তের বাইরে। গুড লেংথ থেকে দুরন্ত একটা লাফিয়ে ওঠা ডেলিভারি ভারতীয় স্বপ্নের সমাধি করে দিল। কাঁটার ওপর নুনের ঘায়ের মতো স্লিপে ক্যাচ ধরলেন বিশ্ব ব্যাটিং হল অফ ফেমে তাঁর নিকটতম প্রতিপক্ষ স্টিভ স্মিথ। ৯৭ টেস্ট খেলে স্মিথের টেস্ট গড় ৫৯। অবিশ্বাস্য বললে কিছুই বলা হয় না। আর ওভালে বোধহয় একদিন তাঁর কৃতিত্বে ফলক বসবে। বা কোনো একটা গেটের নামকরণ হবে। যেমন এসসিজি সম্মানিত করেছে শচীন-লারাকে। ঐতিহাসিক কেনিংটন ওভালে চার টেস্টে তিন সেঞ্চুরি। তার মধ্যে এবারেরটার সুবাদে অস্ট্রেলিয়াকে ডব্লিউটিসিতে এমন প্ল্যাটফর্মে বসিয়ে দিয়েছেন যে সেখান থেকে তাদের স্থানচ্যুত করা দুঃসাধ্য ।
ভারতীয় প্রথম চার ব্যাটার যেভাবে শুরু করলেন সেটা ঠিক স্মিথের উল্টো। স্মিথ যত অনাকর্ষণীয়। তাঁরা ঠিক ততটাই সৌন্দর্যসম্পন্ন। রোহিত দুর্দান্ত সব পুল মারছিলেন । গিল এক্সট্রা কভার দিয়ে ড্রাইভ করলেন যেন মুর্শিদাবাদ সিল্ক। কোহলি বরাবরের মতো ঝকমকে। পূজারাকে দেখে মনে হচ্ছিল মজবুতির সঙ্গে কাউন্টি তাঁকে গতিও দিয়েছে। অথচ চারজনের কেউ কুড়ি পেরোলেন না । স্মিথ সেখানে বিবর্ণ। জড়োসড়ো। স্টিফ। ব্যাট হাতে তাঁর নাড়াচড়া এবং ক্রমাগত শাফল এমনি কুৎসিত যে ফিল্মের হ্যান্ডসাম হিরো কখনো মনে হয় না। বরং ওটিটি নায়কের মতো। রোগাসোগা। কাঁধেই ঝোলা,মুখে ব্রণ।এপিসোড কিছু এগোলে তবে দর্শক অবাক হয়ে বোঝে এ-ই কিনা হিরো।
ওভাল গ্যালারি বিশাল বিলবোর্ডের মাধ্যমে মাঠে থাকা ক্রিকেটারদের প্রতিনিয়ত জানাচ্ছে দ্য আল্টিমেট টেস্ট। আর সেই চূড়ান্ত পরীক্ষায় অজিরা অনেক এগিয়ে গিয়েছে মুখ্যত ট্র্যাভিস হেড ও স্টিভ স্মিথের পার্টনারশিপে। টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হল মোমেন্টাম। কোনো টিম যখন মোমেন্টাম তৈরি করে সাধারণত তারা ম্যাচ নিয়ে চলে যায়। বৃহস্পতিবার ভারতীয় বোলাররা মোমেন্টাম তৈরি করলেন। অনেক আক্রমণাত্মক আর ধারালো মনে হল এদিন। কিন্তু যতটা গর্জাল ততটা বর্ষাল না। শেষ সাত উইকেট গেল। কিন্তু ১৪২ রান খসিয়ে। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের যা হাল তাতে রবীন্দ্র জাদেজাকে দেখিয়েছে সেরা ব্যাটসম্যান। অস্ট্রেলিয়ার সেকেন্ড দিন যোগ করা ১৪২ রান হয়তো টেস্ট নির্ণায়ক হবে না। রাহানে একা কত টানবেন ? কিন্তু বাড়তি কিছু ডলার অস্ট্রেলিয়ার সেভিংসে থাকলে ক্ষতি কী ?
পেস বোলারকে জাজমেন্ট দিতে গিয়ে ব্যাটসম্যান বোল্ড হচ্ছে এমন ঘটনা ভারতীয় ক্রিকেটে হাতে গোনা। বিশ্বনাথ সেই করাচিতে ইমরানকে জাজমেন্ট দিতে গিয়ে কী করে বোল্ড হয়েছিলেন,আজও তাঁকে অনুরাগীরা প্রশ্নেও বিব্রত করে। আর এদিন তো পূজারা এবং গিল দুটো উইকেট গেলো জাজমেন্ট দিতে গিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র ট্রোলিং শুরু হয়ে গেল। ইংল্যান্ডে অন্যতম সফল ভারতের প্রাক্তন তারকা ব্যাটসম্যানকে ধরলাম ফোনে। করাচি টেস্টে বিশ্বনাথের সেই আউট হওয়া যাঁর সামনে থেকে দেখা।
নাহ,তীব্র সমালোচনা নয়। যেটা ভেবেছিলাম অবধারিত শুনব বলে। শুভমান গিল বা চেতেশ্বর পূজারাকে ট্রোল করবেন কী। দূরভাষে মুম্বই থেকে ওঁর গলায় বরং শুনলাম সহমর্মিতা। দিলীপ বেঙ্গসরকরের দ্রুত মনে পড়ে গেল নব্বইয়ের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে তাঁর নিজের আউট হওয়ার কথা।
উপমহাদেশীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ইংল্যান্ডে ফ্রন্টফুট ব্যাটিং-এর ব্যাকরণ যে তিনি চালু করেন তা নিয়ে সমসাময়িক ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে তর্ক নেই। প্রাক বেঙ্গসরকর একটা ধারণা ছিল যে ইংল্যান্ডে যেহেতু বল অনবরত বাঁক খায়, প্রথম মুভমেন্ট হবে পেছনে। দীর্ঘদেহী মারাঠি প্রথম দেখান যে বাঁ পা সামনে নিয়ে যদি শেষ অবধি বল দেখা যায় এবং শরীর রাখা যায় বলের কাছে। ইংরেজ পেসারদের পাল্টা ফ্রন্টফুটে ড্রাইভ করা সম্ভব। কিন্তু সেই তিনিও নব্বইয়ের ম্যানচেস্টার টেস্টে ক্রিস লুইসকে জাজমেন্ট দিতে গিয়ে বোল্ড হন। বেঙ্গসরকার বলছিলেন ,”হয়তো শুভমনরা বোলারের সিরিজ মুভমেন্ট দেখে ঠকেছে। অনেক সময় বোলার স্টাম্পের পাশ থেকে এলে মনে হয় যে আউটসুইং করে বাইরে যাবে। “
সমস্যা হল, ব্যাখ্যা যাই হোক ভারতীয় ব্যাটিং সাম্রাজ্যবাদের খিলান খসে খসে পড়ছে। কাল ডুবিয়েছিল এলোপাথাড়ি বোলিং। এদিন পাঁচ স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের চারজন নিরাশ করলেন। রোহিতদের টেস্টে কামব্যাক করার কথা ছিল দ্বিতীয় দিন। উল্টে ভারত আরো সংকটের গহ্বরে –টেল এন্ড শুরু হয়ে গিয়েছে যে । জাদেজা-রাহানের পার্টনারশিপেও সেই আতঙ্কের ভাইরাস কাটেনি।
ক্রিকেটের আদিম ভাইরাস। যার নাম ফলো অন !